Sunday, December 15, 2024

দোলাচল

 


জীবনের মূল মন্ত্রই হল এগিয়ে চলা। তাই সবাই শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলে - ছোট থেকে বড়, স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি, তারপর কর্মক্ষেত্র। সর্বক্ষেত্রেই শুধু এগিয়ে চলেছে এবং এই এগিয়ে চলার পথে সামনের মাইলস্টোন প্রাপ্তির পেছনে ফেলে আসা মাইলস্টোনের ভূমিকা অপরিসীম। তাই তার ওপর একটা টান বা ভালোবাসা থেকেই যায় যেটা কোনভাবেই কাটানো যায় না।

ইচ্ছে করলেই তো আর সেই পেছনে ফেরা যায় না, কিন্তু তার প্রতি যে আত্মিক টানটা তৈরী হয়ে যায় সেটা কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। একটা মনখারাপের পরশ রয়েই যায়। পুরোনোকে পেছনে ফেলে এক নতুন পথের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় পুরোনোর বিরহে কাতর হবে, না কি নতুনটাকে আলিঙ্গন করে নেওয়ার সুখে মশগুল হবে তা বুঝে ওঠাটাই যেন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এই মিশ্র অনুভূতিটা একদিকে যেমন আনন্দের অন্যদিকে তেমনি দুঃখের।

জীবনের এই মোড়গুলো বড় অদ্ভুত। একদিকে নতুনকে আবিষ্কার করার প্রবল উত্তেজনা অন্যদিকে পুরোনোকে ছেড়ে আসার চাপা কষ্ট, একদিকে নতুনকে জানার খানিকটা ভয়, কৌতূহল অন্যদিকে পুরোনোর প্রতি গভীর মায়া ও টান। জীবনের এই মোড়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়।

সুখের সমান্তরালে এক ধরণের বিষন্নতা কাজ করে এই সময়। এতদিন একসাথে কাটিয়ে আসা সব হঠাৎ করে পর হয়ে যায়। আবার যা কোনদিনও কল্পনা করা হয়নি সেগুলোকে হঠাৎ করে মেনে নিতে হয়। খুব দোটানায় ভুগতে হয় এই সময়টা। একদিকে দূরকে কাছে পাওয়ার জয় তো অন্যদিকে নিকটকে দূরে করার পরাজয়। হায় রে, কি বিচিত্র এই জীবন! 

এই দোলাচল থেকে মুক্তির উপায় হল নিজের চিন্তাধারা, অনুভূতিগুলোকে একটু অন্য ভাবে দেখা। কোথাও থামা যায় না কারণ এগিয়ে চলাই জীবন। পুরোনোটা কোথাও যায় না, সেটা সাথেই থাকে, শুধু একটা নতুন আপন করে নেয়। পুরোনোর স্মৃতি, অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে নতুন আরও অনেক স্মৃতি তৈরী হয়, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। এগিয়ে চলার পথে নিজেদের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য প্রায়শই পুরোনোগুলোকে কালের নিয়মে বিসর্জন দিয়ে হাসিমুখে অনেক নতুনকিছু মেনে নিতে হয়, বলা ভালো মানিয়ে নিতে হয়


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, November 10, 2024

সমালোচনা

 

সৃষ্টি মানেই তাকে নিয়ে চর্চা অবধারিত। কিন্তু বিষয় হল যে চর্চাটা হচ্ছে সেটা আলোচনা না সমালোচনা। আলোচনা হলে তার ভালো খারাপ সব দিকই সামনে  আসে। কিন্তু সমালোচনা হলে শুধু খারাপ দিকটাই প্রচারে আসে, ভালো দিকটা পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকে যায়।

একটা কাজ বা সৃষ্টির পেছনে অনেক কিছুর অবদান থাকে - উদ্ভাবনী শক্তি, চিন্তা, সময়, সৃজনশীলতা। এই সব মিলিয়েই কোন সৃষ্টির সৃষ্টি হয় বা কোন কাজ সম্পন্ন করা হয়। তাই এই সব দিক বিচার বিশ্লেষণ না করে 'শুধু কি অপচয় হয়েছে বা কত কম এর উপকারিতা বা এর থেকেও ভালো করা যেত' এইসব সমালোচনা করলে ব্যাপারটা অবনতির দিকেই যায়।

তারমানে এই নয় যে সমালোচনার কোন দরকার নেই বা সমালোচনা খুব খারাপ একটা বিষয়। জীবনে উন্নতির জন্য গঠনমূলক সমালোচনা অতি অবশ্যই প্রয়োজন যাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ। যদি সত্যিই তার মধ্যে কোন সত্যতা থাকে তবে সেটা নিয়ে ভাবা দরকার ও সেটা ঠিক করে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন। আর যদি কোন সমালোচনা না হয় তবে বুঝতে হবে যে সেরকম সাড়া জাগানো বা আলোড়ন ফেলে দেবার মত আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাজ নয়। 

সমালোচনা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল যেমন কে সমালোচনা করছে, কিভাবে করছে, কাকে করছে, কখন করছে - এইসব বিষয়গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাউকে ছোট করে, আঘাত করে বা সর্বসম্মুখে অপমান করে সমালোচনা একটা জঘন্য অপরাধ যা কখনই কাম্য নয়। একজন অন্যজনের মতামতের সঙ্গে সহমত নাই হতে পারে কিন্তু সেটাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেওয়া বা কোন গুরুত্ব না দেওয়া কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা এবং ক্ষতিকারক সমালোচনার মধ্যে এক বিরাট পার্থক্য রয়েছে। বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা নতুন সৃষ্টিতে সাহায্য করে আর ক্ষতিকারক সমালোচনা শুধু খামতির ওপর দৃষ্টিপাত করে। তাই বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা সবসময় সমাদৃত কারণ তারমধ্যে নতুন সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে থাকে

কখনও কখনও আত্মসমালোচনারও দরকার আছে। আত্মসমালোচনা নিজেকে ছোট দেখানোর জন্য নয় বরং নিজেকে আরও উন্নত, আরও গণ্য করে তোলার জন্য প্রয়োজন হয়। যদি সমালোচনাকে হাসিমুখে গ্রহণ করে তার সঠিক উত্তর দেওয়া যায় তবে এমন ভাবে সবার মাঝে অটল হয়ে দাঁড়ানো যায় যেন এক সর্বাধিক প্রভাবশালী সত্ত্বা যার ওপর কারোরই কোন প্রভাব খাটে না


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, October 13, 2024

শুভ বিজয়া

 




উমা চলে গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল উৎসবের সব আনন্দ, আমেজ, আয়োজন। কয়েকদিনের বাপের বাড়ি সফরে ভবানী তাঁর পরিবার নিয়ে এসে সমস্ত মর্ত্যলোক আলোকিত করে তোলে। এতো আলো, আনন্দ, আয়োজন, হৈচৈ, পরিকল্পনা সব তাঁকে ঘিরেই গড়ে ওঠে। এইকদিন চারদিকে মন্ত্র উচ্চারণ, ঢাকের বাদ্য, কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ পুরো পরিবেশে এক স্বর্গীয় বাতাবরণ এনে দেয়। কিন্তু দশমীর দিন দুর্গার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে মন খারাপের হাওয়া বয়ে চলে।

মহালয়া থেকেই গৌরীর আগমনী সুর বেজে ওঠে। চারদিকে ব্যস্ততা, জমজমাট আয়োজন, নতুন করে সব সাজানো পরিবেশে এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধন হওয়ার পরই আসল পুজোর আমেজ শুরু হয়ে যায়। বরণ করে উমাকে ঘরে তোলা হয়। সবার ভবন আলো করে ভবের ভবানী স্বমহিমায় সপরিবারে বিরাজ করে। দেখতে দেখতে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পার হয়ে যায়। সব মিলিয়ে যেন এক বিশাল যজ্ঞ চলে। প্রতিদিন পাঁজি দেখে পুজো, অঞ্জলি, ভোগ, প্রসাদ বিতরণ, সন্ধ্যারতি এইসব যেন এইকদিনের নিত্যকর্ম হয়ে ওঠে। মণ্ডপে মণ্ডপে মা দূর্গাকে বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন আয়োজনে আপ্যায়ন চলতে থাকে। সপ্তমীর পুজো, অষ্টমীর অঞ্জলি, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণের সন্ধিপুজো সম্পূর্ণ করে নবমীতে সর্বশেষ পুজোর আনন্দে সবাই মেতে ওঠে। দিনগুলো যেন মুহুর্তের মধ্যেই চলে যায়। এরপরই বেজে ওঠে দশমীর বিদায়ের সুর। বরণ করে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ী পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। বিসর্জনের বাজনার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর কাছে বিজয়ার গমন হয়।

যে মণ্ডপ ঘিরে এইকদিন এতো হৈচৈ, উৎসব, আনন্দ, অনুষ্ঠান ছিল সেই মণ্ডপই উমার যাওয়ার পর ফাঁকা পড়ে থাকে। শুধু জ্বলন্ত প্রদীপ তাঁর চলে যাওয়ার  সাক্ষ্য বহন করে। একদিকে মেয়ের বাপেরবাড়ী ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ অন্যদিকে  শ্বশুরবাড়ী ফিরে যাওয়ার আনন্দে বিজয়ার মিষ্টিমুখ দুই মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কুমোরটুলি থেকে গঙ্গাবক্ষ পর্যন্ত যাত্রাটা পলকের মধ্যে যেন শেষ হয়ে যায়। কৈলাস আর ধরিত্রীর মধ্যে আগমন আর গমনের সময়টা নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। কাশফুল যাঁর আগমনের বার্তা বয়ে আনে, গঙ্গাজল তাঁর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ইতি ঘটায়। শুধু রেখে যায় এবছরে তাঁর সঙ্গে কাটানো হাজারো স্মৃতি এবং পরের বছরের জন্য একবুক অপেক্ষা।


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, August 4, 2024

রেলস্টেশন

 



জনসমাবেশের আরেক নাম হল রেলস্টেশন। অসংখ্য মানুষের মিলনক্ষেত্র হল রেলস্টেশন যেখানে সবার জাতি, ধর্ম, রূপ, রং, চলনবলন সব আলাদা। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ এখানে এসে জড়ো হয়, কেউ যাত্রার উদ্দেশ্যে, কেউ বা যাত্রার অন্তিমে। রেলস্টেশন শুরু এবং শেষের মধ্যেকার সেই স্থান যেখানে সবাই কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নেয়, সারা জীবনের জন্য সংসার সাজায় না। কিছু মুহুর্তের জন্য থামা, তারপরেই যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।

রেলস্টেশন এক অন্য অনুভূতি, এক অন্য উদ্দীপনা যা হৃদয়কে মাতোয়ারা করে তোলে। অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানার একটা উত্তেজনা সর্বক্ষণ কাজ করে যায়। রেলস্টেশন মানেই আনন্দ তা সে নতুন কোথাও যাওয়া হোক বা পুরোনো জায়গায় ফেরা। আনন্দ তো দুই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

রেলস্টেশন নতুন শুরুর আনন্দের, উদ্দীপনার প্রতীক। এক নতুন যাত্রার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া; সঙ্গে থাকে অনেক পরিকল্পনা, অনেক স্বপ্ন যেগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য মনে থাকে দৃঢ় সংকল্প, উদ্দামতা। রেলস্টেশন মানেই হল স্বপ্নকে বাস্তব করে ঘরে ফেরা। এক অভিযান সম্পূর্ণ করে অনেক নতুন সম্পর্ক বানিয়ে অগণিত অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসা, সেই অভিযানের বিশ্লেষণ করা এবং আবার এক নতুন অভিযানের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা।

রেলস্টেশন এমন এক জায়গা যেখানে অচেনা মানুষ কিছু সময়ের জন্য হয়তো চেনা হয়ে ওঠে বা কোন নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যেই স্টেশন ছাড়ল সম্পর্কগুলোও হয়তো ভুলে গেল, আবার অন্য কোন স্টেশনে অন্য কোন নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কিছু সময়ের জন্য কথা আদানপ্রদান, তারপর যে যার গন্তব্যে চলে যাওয়া।

কিছু মানুষের কাছে রেলস্টেশন রুজি রোজগারের জায়গা যেখানে তাদের রোজ যেতে হয় কারণ সেখানে আসা যাত্রীদের থেকেই তাদের উপার্জন হয়। আবার কেউ রেলের কর্মী যারা পুরো সিস্টেমটাকে সুষ্ঠ ভাবে চালা। তাদের কাছে সেটা ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল নয় যেখান থেকে তারা অন্য কোথাও যা বা যেতে পারে। তাদের কাছে রেলস্টেশন কর্মক্ষেত্র যেখানে প্রতিদিন তাদের হাজিরা দিতে হয়

সঠিক রেলগাড়ীতে চড়লেই সঠিক রেলস্টেশনে পৌঁছানো যায়। যদি কোন রেলগাড়ী আমাদের স্টেশনে না থামে তবে বুঝতে হবে সেটা সঠিক গাড়ী নয়, তার যাত্রী আলাদা। প্রত্যেক যাত্রীর জন্য নির্দিষ্ট রেলগাড়ী আছে যা তাকে তার সঠিক রেলস্টেশনে পৌঁছে দেয় যা তার গন্তব্যের পূর্ববর্তী সাময়িক স্থান যেখান থেকে সে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়


ঋতুপর্ণা বসাক


Monday, July 8, 2024

গতিশীল জীবন

 


জীবনের চলার পথটা বড়ই বক্র, কখনও ঠিক চলছে তো কখনও বেঠিক। আমরা যা ভাবি সবসময় কি সেটা হয়? বরং আমাদের ভাবনার বাইরেই বেশিরভাগটা হয়; কিছু সময় সেটা খুব ভালো আবার কিছু সময় খুব খারপ। কোনোদিন সব ঠিক, সুন্দর ভাবে যায় আবার কখনও সব উলোটপালোট। এটা একটা প্রক্রিয়া যার কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। চলমান এই জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের শুধু চলতে হয়। এই গতিশীলতার নামই তো জীবন।

জীবনের চলার পথ যদি খুব সহজ স্বাভাবিক হয়ে যায় তবে জীবনটা খুব একঘেয়ে লাগবে। গতিশীল জীবনে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঘটনা ঘটে চলেছে আর আমরা সেই ঘটনার সঙ্গে লড়াই করে চলেছি। নেগেটিভ ভাবে দেখলে মনে হবে একটার পর একটা লড়াই করেই যাচ্ছি, বাঁধা আর কাটছে না। কিন্তু পজিটিভ ভাবে দেখলে বোঝা যাবে এই ঘটনাগুলো আমাদের মধ্যে একটা শক্তি সঞ্চয় করছে, অনেক অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। আর এই শক্তি, অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে চলার পথে আমাদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করে।

গতানুগতিক ধারার স্বাভাবিক ঘটনাগুলো সবসময় সেভাবে ঠিক শেখাতে পারে না। অদ্ভুত অদ্ভুত রোমহর্ষক ঘটনাগুলোই আমাদের স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করে থাকে কারণ সেগুলোই আমাদের প্রকৃত শিক্ষা দেয়। একটা সময় আমরা হয়তো থাকবো না কিন্তু এই ঘটনাগুলো চিরদিন থেকে যাবে যা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো শিক্ষা নেবে। জীবন্ত হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে, মনের মনিকোঠায়, স্মৃতির পাতায়। তখন হয়তো মনে হবে এই ঘটনাগুলো না ঘটলে জীবনটাই একেবারে নিরস অর্থহীন হয়ে যেত।

জীবনের কিছু পথ পিচ্ছিলও হয়। একবার পা পিছলে গেলে পতন অনিবার্য। তাই মেপে মেপে পা ফেলে চলতে হয়। কখনও কখনও কোনো কোনো পথ অস্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু জীবনগতির সঙ্গে সংগতি রেখে ছুটতে ছুটতে আমরাও সেই অস্বাভাবিকতার সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যাই। জীবনের সক্রিয়তা আমাদের তা শিখিয়ে নিয়ে নিজের ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চলতে এবং ভবিষ্যতের লড়াইয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

"চলাই জীবন থেমে যাওয়াই মরণ" - তাই লড়াই ছেড়ে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা তো সম্ভব নয় কারণ জীবনের গতিশীলতা আমাদের সেটা করতে দেবে না। সবারই নিজস্ব একটা জীবন আছে এবং সে জীবনেই তাকে ফিরে যেতে হবে। মনে দৃঢ় বিশ্বাসের সঞ্চার ঘটিয়ে জীবনের প্রতিকূলতাগুলোকে ছোট করে দেখলে জীবনের পথ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোটা বোধহয় সহজতর হয়ে ওঠে কারণ বিশ্বাস থাকলে ভয় নয়, জয় অনিবার্য

ঋতুপর্ণা বসাক

Saturday, June 22, 2024

আবেগ কথা

 


জীবনে আমরা কখনও কখনও এমন কিছু মোড়ে এসে দাঁড়াই যেখান থেকে সঠিক পথ বেছে নেওয়াটা কঠিন হয়ে ওঠে। নিজেকে নিজের কাছে একটা পাজল্ড রুবিক্স কিউব মনে হয় যেটাকে বারবার ওলোটপালোট রং মেলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই। আর আমাদের আরও বেশি দ্বন্দে ফেলে দেয় আবেগ নামক জিনিসটা যেটা এই সময় আরও বেশী সক্রিয় হয়ে যায়। আবেগ অনেকটা ঢেউয়ের মতো। মাঝে মাঝে অত্যাধিক আবেগের বশবর্তী হয়ে হুট্ করে নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল আমাদের সারাজীবন দিয়ে যেতে হয়। তাই নিজের চেতন আর অবচেতন মনটাকে এমন ভাবে তৈরী করতে হ যেন এরকম পরিস্থিতিতে বিভ্রান্ত না হয়ে সঠিক পথটা বেছে নিতে পারি।

কাজটা অতটা যেমন সহজ নয় তেমন অতটা কঠিনও নয়। তারজন্য প্রথমে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হয়। সবার সামনে আবেগ প্রকাশ করা একেবারেই কাম্য নয়। আত্মরক্ষার জন্য কিছু মানুষের সামনে নিজেকে কঠিনতার আবরণে আড়াল রাখতে হ। এই কঠিনতাই আমাদের সেই শক্তি যা আমাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করে। প্রত্যেকেরই কোন না কোন দুর্বলতা থাকে তা সে যতই কঠিন হোক না কেন। তবে নিজের সেই দুর্বল দিকটা কোনভাবেই সবার সামনে প্রকাশ করতে নেই। কারণ চারপাশে অনেক মানুষ আছে যারা ওই দুর্বলতাকে হাতিয়ার করে ক্ষতি করতে সচেষ্ট হয়ে পড়ে। তাই নিজেকে এমনভাবে রাখতে হয় যাতে কেউ আমাদের শক্তির অপব্যবহার আর দুর্বলতার ব্যবহার করতে না পারে।

অত্যধিক আবেগ যেমন বিপদজনক তেমনি একেবারে অনুভূতিশূন্য হয়ে যাওয়াও ক্ষতিকারক। একজনের মনে যদি কোন আবেগই না থাকে, কোন কিছুর সঙ্গে অনুভূতি জড়িয়ে না থাকে তবে জীবন চলবে কি ভাবে? আমাদের চারপাশে সবকিছুর সঙ্গে কোন কোন আবেগ জড়িয়ে আছে, আর সেটাই আমাদের সব কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সেই আবেগ যদি অত্যাধিক বেড়ে বা কমে যায় তবেই তা বিপদজনক। খাবারে পরিমাণমত লবণের মতো পরিমাণমত আবেগ জীবনকে সুষ্ঠভাবে চালিত করে, সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত ঘাটতি বা বাড়তি আবেগ জীবনকে বিপন্ন করতে খুব একটা সময় নেয় না। তারজন্য নিজেদের সেভাবে গড়ে তুলতে হয় যাতে সঠিক সময়ে নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হই। পাজল্ড রুবিক্স কিউবের রং মেলানোর জন্য যে সঠিক টার্নটার দরকার ছিল সেটা সঠিক ছোঁয়ায় সমাধান করে সব রং যেন মিলিয়ে দিতে সফল হই


ঋতুপর্ণা বসাক

Thursday, May 23, 2024

আলো আঁধারির খেলা

         


সারা জগৎ জুড়ে আলো আঁধারির খেলা চলছে। কখনও কোথাও আলো আবার কখনও কোথাও অন্ধকার এর মধ্যে দিয়েই জীবন চলছে। আলো মানেই সব ভালো উজ্জ্বল আর আঁধার মানেই সব খারাপ কালো এটাই প্রথমে মনে আসে; কিন্তু বাস্তব চিত্রটা অনেক সময় অন্য রকমও হয়। অন্ধকারে পথ হারিয়ে গেলে যেমন আলোর খোঁজ করি ঠিক তেমন আলোতে চোখ ঝলসে গেলে অন্ধকারের খোঁজ করি। উজ্জ্বলতার জন্য যেমন সূর্যের অপেক্ষা করি তেমন স্নিগ্ধতার জন্য চাঁদেরও অপেক্ষা করি। জীবনে দরকার তো দুজনেরই আছে।

আলো আঁধার একে অপরের পরিপূরক। আঁধার না থাকলে যেমন আলোর উজ্জ্বলতা বুঝতাম না ঠিক তেমনি আলো না থাকলে অন্ধকারের স্নিগ্ধতাও বোঝা যেত না। তাই এরা একজন আরেকজনের গুরুত্ব বোঝায়। দিনের বেলা আকাশে যেমন রোদ ঝলমল করে তেমনি সন্ধ্যে বেলায় আঁধার ঠিক নামে। কখনও হয়তো আলো অনেক দীর্ঘ হয় তো কখনও আঁধার। একদিকে যেমন অন্ধকারে দিশাহীন ভাবে ঘোরার পর কোন আলো যখন পথের সন্ধান দেয়, নতুন উদ্দমতা আনে তখন তার প্রকৃত গুরুত্ব বোঝা যায়; অন্যদিকে ঠিক তেমনি অনেকক্ষণ আলোতে থাকার পর  আমাদের ক্লান্ত শ্রান্ত দেহ মন অন্ধকারেই স্নিগ্ধতা স্থিরতা অনুভব করতে পারে যা এক প্রশান্তি বয়ে আনে। আলো আঁধার একসাথে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে।

আমাদের প্রত্যেকের মনে আলো আঁধার দুইই উপস্থিত রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমরা কিভাবে তার ব্যবহার করছি যা সম্পূর্ণ নির্ভর করে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও মনোবৃত্তির ওপর। আর এই আলো আঁধারের ব্যবহারই একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয় বুঝিয়ে দেয়। কেউ হয়তো সামান্য আলো দিয়েই অনেকটা অন্ধকার দূর করে ফেলে, আবার কারও মনে এতো আঁধার যে বাইরের এতো আলোও সেখানে কোন প্রভাব ফেলে না। চারপাশের এতো আলো সত্ত্বেও মানুষের মনের অন্ধকার দূর করতে হলে নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। তার জন্য বাইরের আলো নয়, ভেতরের আলো জ্বালাতে হবে। চারপাশের আঁধারের মধ্যে কেউ যদি আলো হয়ে পথের কান্ডারী হয় তবে বুঝতে হবে তার ভেতরের আলো প্রজ্জ্বলিত হয়েছে।

দিনের বেলা সব দেখার জন্য যেমন আলো অপরিহার্য ঠিক তেমন রাতের বেলা চাঁদের জ্যোৎস্না, তারাদের উজ্জ্বলতা বোঝার জন্য আঁধার অপরিহার্য। আকাশের গায়ে রামধনু দেখার জন্য যেমন দিনের আলো অপরিহার্য তেমনি আকাশের বুকে তারাদের মেলা দেখার জন্য অন্ধকার অনিবার্য। সূর্য ছাড়া যেমন দিন অসম্ভব তেমনি চাঁদ ব্যতীত অন্ধকার কল্পনাতীত। চাঁদের উজ্জ্বলতা, তার বৈশিষ্ট্যতা, তারাদের স্থান, তাদের নকশা, বোঝার জন্য আঁধারই একমাত্র উপায়। মোমবাতির বা প্রদীপের আলোর মাহাত্ব বুঝতে হলে তাকে অন্ধকারেই জ্বালাতে হবে। পুজোর সময় বিভিন্ন আলোর খেলা দেখার জন্য সবাই রাতেই ঠাকুর দেখতে পছন্দ করে। দিনের তো রাতেরও যে নিজস্ব একটা সৌন্দর্য আছে তারও যে বিশেষত্ব আছে। আলোর এতো কদর কিন্তু অন্ধকারের জন্যই। তাই অন্ধকারকেও ভালোবাসতে হয় আর নিজের আলোয় সবার জীবন আলোকিত করার চেষ্টা করতে হয়।

আলো আঁধার একে অপরের বিনা অসম্পূর্ণ, দুজনে মিলে একে অপরকে পূর্ণ করে। একজনের উপস্থিতিতেই আরেকজনের প্রাধান্য প্রকাশ পায়। আলোর সাথে আলো থাকলে বা আঁধারের সাথে আঁধার থাকলে কিছুই পাওয়া যাবে না। আলো আঁধারের বৈপরীত্য একে অপরকে একে অপরের গুরুত্ব বোঝায়, তাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য চেনায়।

Let the Light follow the Darkness.

Let the Darkness coexist with the Light.

To be Whole and One, we need both Dark and Light.


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, May 5, 2024

দূরের যাত্রী

 



জীবনের যাত্রা পথে আমরা বিভিন্ন যাত্রীর সঙ্গে পরিচিত হই। কেউ ক্ষনিকের জন্য, কেউ মাঝামাঝি, আবার কেউ দীর্ঘ পথের সহযাত্রী হয়। নিয়তি কখন কবে ভিন্ন ভিন্ন অচেনা পথের যাত্রীদের কোন অজানা মোড়ে মিলিয়ে দেয় কেউ জানে নাআবার সে কখন কোন মোড়ে কাদের আলাদা করে দেয় কেউ বলতে পারে না। তখন তার সঙ্গে কাটানো স্মৃতিটুকুই বাকি পথের সম্বল হয়ে রয়ে যায়।

জীবনের যাত্রাগুলো একেকটা গল্পের মতো। যারা এই জীবনের যাত্রা ছেড়ে অন্য জীবনের পথে পা বাড়ায় সেক্ষেত্রে যাত্রাগুলো হঠাৎই যেন থেমে যায়, গল্পগুলো যেন হঠাৎ করে অসমাপ্ত রয়ে যায়। পরিসমাপ্তিটা যেখানে আনন্দদায়ক হতে পারতো সেটা এক করুণ পরিণতি পায়। গল্পটা যেখানে আমাদের হতে পারতো সেখানে নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে শুধু আমার হয়ে রয়ে যায়

এই জীবনের যাত্রাপথে হঠাৎ ছেড়ে যাওয়া সেই প্রিয়জন বা যাত্রীর স্মৃতিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। তার ব্যবহৃত সব পার্থিব বস্তুগুলো বর্তমান অথচ সেই মানুষটা অপার্থিব হয়ে গেছে। কিছু বিশেষ দিনে কষ্টটা যেন আরও বেশী করে অনুভূত হয়। সেই বিশেষ দিনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলো প্রতিক্ষণে তার অনুপস্থিতির জানান দেয়। তখন মনে হয় ছুটে তার কাছে চলে যাই। আবার কখনও মনে হয় কোন এক জাদুবলে যদি সে ফিরে আসে। কোথাও অসম্ভব জেনেও আমরা যেন তার অপেক্ষা করি। 

বাস্তবিক যাত্রার মাঝপথে ছেড়ে যাওয়া সেই যাত্রীর অপেক্ষা করে সত্যিই তো কোন লাভ হয় না। যার পথ চেয়ে বসে থাকা সেই পথিকের তো পথ বদলে গেছে, সে তখন এক নতুন পথের যাত্রী  তাই তার আশা করা মানে নিজেকে বোকা বানানো আর কষ্ট দেওয়া। আর আমরা সেই যাত্রায় তো ভাগও নিতে পারবো না কারণ দুই যাত্রা দুটো ভিন্ন জগতের যাদের মাঝখানে কোন সেতুবন্ধন নেই

দূরের সেই যাত্রীর সঙ্গে তখনই মিলিত হতে পারবো যখন আমরা সেখানে পৌঁছাবো। তার আগে সে তো আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কোন মোবাইল, টেলিফোন, চিঠি, ইন্টারনেট কিছুই কাজে আসে না। তাদের সঙ্গে জড়িত স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। মনের মনিকোঠায় জমিয়ে রাখা সেই স্মৃতিগুলো নিয়েই বেঁচে থাকার চেষ্টা করি, শূন্যস্থানটাকে অনুভব করে জীবনে চলতে চেষ্টা করি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শূন্যস্থান পূরণ তো হয়ই না বরং আরও বেশী করে অনুভূত হয়। 

কেউ চলে গেলে সবাই বলে RIP - "Rest in Peace" মানে "শান্তিতে বিশ্রাম নাও"।

কিন্তু Dr. A P J Abdul Kalam এর উক্তিতে...

RIP হল "Return if Possibleযার অর্থ হল "যদি সম্ভব হয় ফিরে এসো"


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, April 14, 2024

আগমনী নববর্ষ - বিদায়ী পুরাতন বর্ষ

 


একটা নতুন বছরের আগমনের সঙ্গে একটা পুরোনো বছরের বিদায় অবশ্যম্ভাবী। এক নতুনের আবির্ভাব আর এক পুরোনোর সমাপ্তি ঘটে। নতুন বর্ষের পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই পুরাতন বর্ষের পরপারের বিদায়ের ঘন্টা বেজে যায়। পুরাতন বর্ষ বিদায়ের সময় নতুনকে তার শুভেচ্ছা জানিয়ে যায় যাতে সে পুরাতনের সব দোষ, ভুল, অন্ধকার নাশ করে এক নতুন আলো নিয়ে আসে।

নতুন বছর আগমনের বার্তা মানেই বিগত সারা বছরের হাসি কান্না পুঁটলি বেঁধে সুখ দুঃখের পুঁজি সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ বছর উধাও হয়ে যায়; যাকে চাইলেও আর ফিরিয়ে আনা যায় না। সে শুধু আমাদের স্মৃতির মনপল্লীর কোন এক কুঠুরিতে থেকে যায়। হয়তো মাঝে মাঝে সেগুলোকে মনে করে কখনও খুশি হই বা কখনও কষ্ট পাই। সেই সব অভিজ্ঞতার ভালো খারাপ বিচার বিশ্লেষণ করে জীবনের পথে কাজে লাগাই কিন্তু সেই পুরোনো বছরকে আর কোনভাবেই ফিরিয়ে আনতে পারি না

পুরোনো বছরের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন বছর দ্বারে এসে দাঁড়ায়, তাকে স্বাগত জানানোর আহ্বান জানায়। মুখের হাসি আর বুকভরা ভালোবাসা দিয়ে আমরা নতুন বছরকে স্বাগত জানাই। তাকে নিয়ে অনেক নতুন স্বপ্ন সাজাই। যা গত বছরে করা হয়নি সেটা নতুন বছরে কার্যকর করার যথাসম্ভব প্রয়াসে তৎপর হয়ে উঠি। পুরোনো বছরের রোগ, অসুখ সারিয়ে নতুন বছরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাই। নববর্ষ মানেই অনেক স্বপ্ন অনেক আশা, নতুন করে ভালোবাসা

নতুন পুরোনো কেউই আলাদা নয়, সবাই জীবনের অংশ। আজ যা নতুন কাল তা পুরোনো হয়ে যাবে। দিন, মাস, বছর সবাই কালের নিয়মে এগিয়ে যায়। নববর্ষ যেমন নতুন বার্তা নিয়ে আসে পুরাতন বর্ষও অনেক বার্তা দিয়ে যায়। পুরোনো বছর থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন বছরে কাজে লাগানোই আসল উদ্দেশ্য হওয়া দরকার

পুরোনো যায় নতুন আসে 

              এগিয়ে চলে বছর 

সুখ দুঃখ, কান্না হাসির 

                      অভিজ্ঞতা বাড়ে জীবনভর।


ঋতুপর্ণা বসাক

Saturday, March 16, 2024

সিনেবন

 


জীবনটা মাঝে মাঝে সিনেমার মতো লাগে যেখানে সংলাপগুলো বড্ড বোকা বোকা লাগে, খুব চেনা চেনা লাগে। কিন্তু তারমধ্যেই কিছু সংলাপ তা সে পদ্য হোক বা গদ্য মনে চিরকালের জন্য দাগ কেটে যায়। এই সংলাপগুলো শুনলে মনে হয় যেন এটা আমার জন্যই লেখা হয়েছে বা আমাদের জীবন থেকেই নেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে আমরা যেন একেবারেই মিশে যাই।

কখনও জীবনের শিক্ষা থেকে সিনেমা হয় আবার কখনও সিনেমা থেকে জীবনের শিক্ষা নিই। দুটোই একে অপরের পরিপূরক, শিক্ষক, বন্ধু, পরামর্শদাতা এবং সবশেষে দুইয়ে মিলে হয়ে ওঠে সিনেবন। আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত সিনেমা, নাটক এসব ঘটে চলেছে আর আমরা তার কাহিনীকার, অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক সব চরিত্র একসাথে চরিত্রায়ন করে চলেছি। যদি সঠিক ভাবে চরিত্রায়ন হয় তবে সিনেমা সুপারহিট অর্থাৎ কোন সমস্যা ছাড়া সব ভালো ভাবে সুসম্পন্ন হয়। আর যদি চরিত্রায়ন ঠিক ভাবে না হয় তো সমস্যার সৃষ্টি এবং তার জন্য নতুন স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু অর্থাৎ সমাধান বার করা।

প্রত্যেকের নিজস্ব একটা সিনেমা আছে, প্রত্যেক বয়সের একটা সিনেমা আছে; কোনটা হাসির, কোনটা কান্নার, কোনটা দুঃখের, আবার কোনটা লড়াইয়ের। এই প্রত্যেকের সিনেমা আমাদের প্রত্যেককে কিছু না কিছু শেখাচ্ছে। একের শক্তি অন্যকে দিয়ে তাকে শক্তিশালী করার আর অন্যের শক্তি নিয়ে নিজের দুর্বলতা দূর করার প্রতিনিয়ত এক নিরলস প্রচেষ্টা চলছে।

জীবনটা উপভোগ করার জন্য; অভিজ্ঞতা, শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সর্বতভাবে সফল হওয়ার জন্য। এই প্রতিনিয়ত হারজিত, সুখদুঃখ, সফল অসফল, হাসিকান্না সবরকম চরিত্রায়নের মাধ্যমে জীবনের রঙ্গমঞ্চে তার উদ্দেশ্য খুঁজে নতুন নতুন সিনেমা তৈরী করে তার সঠিক ভাবে সম্পাদন করে তাকে প্রাণভরে বাঁচাই হল জীবনের মূল মন্ত্র


ঋতুপর্ণা বসাক

Saturday, February 24, 2024

দিকশূন্যপুর

 


জীবন মাঝে মাঝে আমাদের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করায় যেখানে আমরা কোন দিক খুঁজে পাই না, সম্পূর্ণ অচেনা এক পরিস্থিতিতে আমরা এসে দাঁড়াই। মনে হয় যেন এক পথভ্রষ্ট পথিক নিজের রাস্তা হারিয়ে কোন এক অজানা দেশে এসে উপস্থিত হয়েছে যেখান থেকে সে বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ, কোন দিকে যাওয়া উচিৎ। যেন কোন এক দিকশূন্যপুরে তার এক অযাচিত অতিথি হয়ে সে সেখানে এসে পড়েছে যেখান থেকে ফেরাটা অতটাও সহজ নয় তবে অতটা কঠিনও নয়।

কথায় আছে দিক গতির থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ দিক আছে গতি নেই চললেও গতি আছে দিক নেই কখনই চলতে পারে না। কখনও কখনও মনে হয় আমাদের চারদিকে অন্ধকার, কোন দিকে এগোবো? আমরা যেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলেছি যার কোন শুরু বা শেষ নেই। যে দিক নির্ণয় করে এগিয়েছিলাম সেই দিকে আর এগোবো কি না বা উল্টো দিকে ফিরে যাবো কি না সেই নিয়ে মনে দ্বন্দ্ব তৈরী হতে থাকে। 

মাঝে মাঝে এরকম দিকশূন্যপুরে হারিয়ে যাওয়া ভালো কারণ সেখান থেকেই নতুন রাস্তা নতুন দিক আবিষ্কৃত হয় এবং আমরা নিজেদের নতুন দক্ষতা সম্বন্ধে পরিচিত হই। আমরা হয়তো নিজেরাই জানতাম না আমাদের মধ্যে কোন কোন বিশেষ ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। দিকশূন্যপুরে গিয়ে আমরা তাদের নতুন ভাবে খুঁজে পাই যা আমাদের নতুন দিকের সন্ধান পাইয়ে দেয়। প্রত্যেকেই আমরা কখনও না কখনও কোনভাবে দিকশূন্যপুরে গিয়ে উপস্থিত হই কারণ প্রতিটা নতুন আবিষ্কারই কিছু সময়ের জন্য কোন এক দিকশূন্যপুরে হঠাৎ করে পৌঁছানোর পরই হয়

দিকশূন্যপুর এমন এক জায়গা যেখানে বাহ্যিক কোন উপকরণ বা বস্তু কাজ করে না, একে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। এখানে খুঁজতে হলে নিজের ভেতরে খুঁজতে হয়। গভীর ভাবে নিজের মনের ভেতর উঁকি মারলে সেই হারিয়ে যাওয়া দিক সামনে এসে দাঁড়ায় আর তার সঙ্গে সেখানে পৌঁছানোর রাস্তাও। শুধু শান্ত ভাবে ধৈর্য্য সহকারে মনোযোগ দিয়ে নিজের মনের ভেতর দৃষ্টিপাত করতে হয়। আর সেখানেই ভেসে ওঠে বিশ্বরূপ এবং অনুভূত হয় বিশ্ববোধ যা আমাদের সবাইকে একাত্মবোধে বেঁধে রাখে

জীবন যাত্রায় চলতে চলতে কোন এক ক্লান্ত অবসন্ন মনে নিজেদের আমরা হারিয়ে ফেলি। চেতনার কোন এক গোধূলি বেলায় সব অনুভূতি, ব্যথা বেদনা নিয়ে, স্মৃতি সঞ্চয় করে দেহ মন ভেসে যায় কোন এক সুদূরপানে। সেখানে যেতে যেতে পরিচিত সব রং, রূপ, লোকালয়, পার, চেনা পরিচিত সব দৃশ্য আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসে। স্থলে, জলে, বিশ্ববৈচিত্র্যে এক নিঃশব্দতা নেমে আসে। আর আমরা হারিয়ে যাই সে এক অচিনপুরে, এক দিকশূন্যপুরে !!!

এক কৃষ্ণ অরূপতা নামে বিশ্ববৈচিত্র্যের পরে
স্থলে জলে। ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ
অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আসি
একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড় হাতে—
হে পূষন, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল,
এবার প্রকাশ করো তোমার কল্যাণতমরূপ,
       দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার মাঝে এক।       
                                                                                                              - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঋতুপর্ণা বসাক 


Tuesday, January 23, 2024

বই মহোৎসব

 




প্রতি বছর বইমেলা ভরপুর প্রানশক্তি, বিপুল জনজোয়ার, নতুন বই আবিষ্কারের সাক্ষ্য বয়ে নিয়ে চলেছে। ছোট বড় মাঝারি সব স্টল, ছোট ছোট পত্রিকার টেবিল, নতুন নতুন বইয়ের প্রকাশ সব মিলিয়ে যেন এক মহোৎসব চলে। 

এ যেন বইয়ের এক মহাসমুদ্র যাকে যত অন্বেষণ করা যায় ততই নতুন নতুন সব রত্ন বই আবিষ্কার হয়। প্রতিটা বইয়ের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব নতুনত্ব রয়েছে যার বিষয়, রং, গন্ধ, ওজন, মাপ, ছবি সব একে অপরের থেকে আলাদা। 

কোথাও অনেক বই বিক্রীর খুশি আবার কোথাও কম বিক্রীর মনখারাপ, কোথাও প্রবল উত্তেজনা আবার কোথাও বইমেলার প্রতি এক তীব্র আসক্তি। সব মিলিয়ে বইমেলাকে পরিপূর্ণ করে তোলে যেখানে ক্রেতা, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, এবং অবশ্যই বই সবার নিজ নিজ নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।

বইমেলা এমন জায়গা যেখানে অনেক নতুন প্রজন্মের লেখক, চিত্রকর, কবির প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। অনেকের আশার জায়গা বইমেলা কারণ যত বই বিক্রী হবে তত লেখক, কবি, চিত্রকর, সাহিত্যিকদের নাম হবে, প্রকাশকদের লাভ হবে। লেখকমহলে পরিচিতি হবে, কবিতা, চিত্র, সাহিত্যের জগতে জনপ্রিয়তা বাড়বে।

বইপ্রেমীদের ভালোবাসার জায়গা হল বইমেলা যেখানে অসংখ্য বইয়ের স্টল একসাথে দেখতে পাওয়া যায়, দূরদূরান্ত থেকে প্রকাশকরা বই নিয়ে আসে। একদিকে যেমন স্থানীয় প্রকাশকরা তাদের স্টল সাজায়, তেমনি অন্যদিকে দেশ বিদেশ থেকে আসা বিখ্যাত প্রকাশকরা তাদের বইয়ের পসরা সাজিয়ে তোলে।

বইমেলা আসে, সাথে নিয়ে আসে নতুন বইয়ের ঠিকানা, নতুন লেখকের আবির্ভাব, অনেক প্রকাশকের সন্ধান। বইমেলা চলে যায়, সাথে দিয়ে যায় অনেক নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন পরিচিতি, নতুন আবিষ্কার ও অনেক আনন্দ। তার সাথে রেখে যায় আগামী বছরের আবার বইমেলার অপেক্ষা, চাতকের মত বইপ্রেমীদের তীর্থসঙ্গমে মিলিত হবার প্রতীক্ষা


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, January 7, 2024

জীবনের ব্যথা!

 


জীবন প্রত্যেকের কাছেই খুব মূল্যবান, খুব প্রিয়, খুব ভালোবাসি তাকে আমরা। আর ভালোবাসলে তার যত্ন করতে হয়, খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু বাস্তব ছবি টা বোধহয় অন্যরকম। জীবনটাকে যেন আমরা বড্ড বেশী জটিল করে ফেলেছি। যেটা একটা সরলরেখায় বইতে পারতো তাকে  আমরা অনাবশ্যকভাবে বক্র রেখায় চালনা করে ফেলেছি। প্রয়োজনীয়তা আর চাহিদার মধ্যের পার্থক্যটাকে গুলিয়ে ফেলেছি; নিজেদের সম্পদের দিকে না তাকিয়ে অন্যদের সম্পদের দিকে বড্ড বেশী নজর দিয়েছি। ক্রমাগত অভিযোগ করে নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলেছি। 

এক অসম প্রতিযোগিতায় ভাগ নিয়ে জীবনকে যেন বড্ড বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। সেও যেন এতো জটিলতা নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠেছে। অবসন্ন কোনো দুপুরে ক্লান্ত হয়ে বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে যা আমরা দেখতে পাইনি বা বলা ভালো দেখতে চাইনি। রাতের অন্ধকারে একাকিত্ব অনুভব করে কেঁদে উঠেছে যে কান্না আমরা শুনতে পাইনি বা বলা ভালো শুনতে চাইনি। সবসময় তাকে একপ্রকার উপেক্ষা করে গেছি।

এই বক্র রেখায় চলতে গিয়ে তীব্র আঘাত পেতে পেতে একসময় সে চুপ করে গেছে আর তার এই নিঃশব্দতা আমরা অনুভবও করতে পারিনি। কোথাও আমরা জীবনকে বড্ড হালকাভাবে নিয়ে নিয়েছি; কোথাও মনে হয়েছে এর ওপর আমার একচ্ছত্র অধিকার, যা খুশি করতে পারি, যেমন খুশি চালাতে পারি, যে শত অত্যাচারেও কোন প্রতিবাদ করবে না।

কিন্তু তারও যে একটা মন আছে সেটা কোথাও আমরা ভুলে গেছি। তারও যে কষ্ট হয়, দুঃখ হয় সেটা যেন আমরা ভাবতেই পারি না। তাই যেখানে খুব সরল ভাবে সাধারণভাবে জীবনকে চালানো যায় সেখানে অনেক জটিল ভাবে কঠিনভাবে তাকে চালাচ্ছি। নিজেদের লোভ, আকাঙ্খা পূরণ করতে গিয়ে তাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি, তার ব্যথা ক্রমশঃ বাড়িয়ে তুলছি।

যেদিন সে বিদ্রোহ করে উঠবে সেদিন হয়তো আমরা বুঝতে পারব কতটা অন্যায় তার সঙ্গে আমরা করেছি। আর সেদিন হয়তো প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ টুকুও পাবো না। তাই সময় থাকতে জীবনের জন্য কিছু করতে হলে সরলভাবে কাটানোর চেষ্টা করে তাকে একটু শান্তি আমরা দিতেই পারি। তার ব্যথাকে অনুভব করে সেটাকে কমানোর একটা চেষ্টা অন্তত করতে পারি। যাকে সবথেকে বেশী ভালোবাসি তার জন্য এটুকু তো করাই যায়। তাই না?


ঋতুপর্ণা বসাক

শ্রোতা ও বক্তা

  শ্রোতা ও বক্তা শব্দ দুটো নিজেরাই নামের মধ্যে নিজেদের চারিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করে দেয়। একজন বলে একজন শোনে। যে বলে সে বক্তা, আর যে শোনে সে ...

Popular Posts