বাঁধন-হারা নদী চিরকাল প্রবাহমান যার কোথাও কোনও ঘর নেই, যে কখনও কোথাও থেমে থাকে না। একই জলকে আমরা কখনও দুবার স্পর্শ করতে পারি না কারণ একবার স্পর্শ করার পরই সে জলধারার সাথে বয়ে গেছে এবং আর কখনও পেছনে ফিরে আসে না। নদীও অনেকটা জীবনের মতো, একবার বয়ে গেলে আর পেছনে ফিরে তাকায় না। সে শুধু এগোতে জানে; অতীতকে পেছনে ফেলে বর্তমানের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে।
নদীর সবথেকে বড় বিশেষত্ব হল সে কোন বাঁধা মানে না। যেখানেই বাঁধা পায় তা ভেঙে গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলে; আর যদি ভাঙতে না পারে তো বিকল্প পথ খুঁজে নিয়ে তার নিয়তির দিকে এগিয়ে যায়। সে যেন ঘরছাড়া এক যাত্রী যে কোথাও কখনও থামতে জানে না; নিজের গন্ত্যব্যে পৌঁছানোই যার একমাত্র লক্ষ্য। কোনও দেশের সীমানাও তাকে আটকাতে পারে না। কোনও দেশের সীমা পার করতে গেলে যেখানে হাজার নিয়ম মানুষকে মানতে হয়, সেখানে নদী অনায়াসে সেই সীমা অতিক্রম করে এগিয়ে যায়; আর তারজন্য তাকে শাস্তি দেবার বা আটকে রাখার অধিকার, ক্ষমতা বা শক্তি কোনোটাই কারোর নেই।
নদীর যাত্রাপথে অনেক বাঁক তৈরী হয়, অনেক পাড় ভাঙে, অনেক পাড় গড়েও ওঠে; কিন্তু তার এসব দিকে কোন ধ্যান নেই। সে অর্জুনের মতো সমুদ্রকে পাখির চোখ করে তার দিকে এগিয়ে চলে কারণ পরিশেষে তাকে যেতে সমুদ্রের সাথে মিলিত হতে হবে; এটাই তার নিয়তি। যেন এই শৈবলিনী কোন এক অভিশাপ যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে যার শাস্তিস্বরূপ তার কোথাও থামার অনুমতি নেই। তাই যতক্ষণ না সে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে তার কোন অবসর নেই; সে তার লক্ষ্যে অবিচল থাকে। পাড় ভাঙা-গড়া, জোয়ার-ভাটা কোনকিছুই তাকে প্রভাবিত করে না।
নদী হল এক মিলনতীর্থ যার জলধারায় শব্দ, তরঙ্গ, উচ্ছলতা, আন্দোলন এবং অনন্ত বৈচিত্র দেখা যায়। এই ধরণীর বুকে নদী হল প্রাণ যার ওপর অন্যান্য সব প্রাণ নির্ভরশীল। নদীকে কেন্দ্র করেই জনবসতি গড়ে ওঠে যা একটা সভ্যতার পরিচয় বহন করে। নদী আমাদের জীবনকে লালনপালন করে এবং একটা সভ্যতার স্তম্ভ যাকে ছাড়া সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। নদী আমাদের মধ্যে ভেদাভেদ মেটায় কারণ অসংখ্য রূপ, বর্ণ, গন্ধের ভীড়ে তৃষ্ণা সবার এক।
নদী নিজে কখনও নিজের জল পান করে না; সেই জল তো জগতের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। যাদের জীবন তার ওপর নির্ভর করে তাদের শত অত্যাচার সহ্য করেও সে তার কর্তব্য থেকে পিছুপা হয় না, জগৎকে জল দিয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার কাজ সে বন্ধ করে না। সে তার কর্তব্য না করলে এই জগৎ পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কারণ জলই জীবন যাকে ছাড়া কোন প্রাণের অস্তিত্বই থাকতে পারে না।
নদীর কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলার প্রবণতা দেখে তাকে হয়তো ধ্বংসকারী মনে হতে পারে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে সে এটা তার শক্তি প্রদর্শনের জন্য করছে না বা কারও ক্ষতির উদ্দেশ্যে করছে না। এগিয়ে চলা তার ধর্ম, আর সেই ধর্মের জন্য সে তার কর্ম করে যাচ্ছে মাত্র। তাই তার এই অধ্যাবসায় থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার, তাকে সম্মান জানানো উচিৎ।
রৌদ্রছায়ার খেলাঘর হল নদী যার নিদর্শন উষা বা গোধূলি বেলায় দেখতে পাওয়া যায়। এই আলো-আঁধারির খেলার সময় নদীর বুকে সৃষ্ট চকমকি আলো প্রকৃতির মধ্যে এক মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে যা অন্য কোথাও একান্তই বিরল। নদীরও একটা মন আছে, তারও মন ভালো খারাপ হয় যেটা সে হয়তো জোয়ার-ভাটার খেলায় প্রকাশ করে। ভাটায় তার জল নিচে নেমে গিয়ে হয়তো মন খারাপের ইঙ্গিত করে; আবার জোয়ারে ফুলে ফেঁপে উঠে সে তার আনন্দ উচ্ছলতাকে ব্যক্ত করে।
উৎস থেকে মোহনার পুরো যাত্রায় নদী অসংখ্য অগণিত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, রূপের সাথে পরিচিত হয়, অভিজ্ঞতা লাভ করে, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়; কিন্তু সে প্রকাশ করে না বা বলা ভালো করতে পারে না। "এতো জানে তবু নদী কথা বলে না, কেন বলে না" - কি অদ্ভুত পরিহাস! আদি থেকে অন্ত পুরো যাত্রার সে এক পাগল-পারা, বাঁধন-হারা যাত্রী যে নীরবে শুরু থেকে নিজের লক্ষ্যে অবিচল অবিরাম ভাবে অন্তিমের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ড: ঋতুপর্ণা বসাক
Khub deep messege ma'am lekha tar.....khub bhalo laglo pore🥺🥺♥️♥️♥️♥️♥️♥️
ReplyDeleteThank you 😊
DeleteThe photos along with your writing has a very deep message with human lives.Excellent indeed.After reading this I can only recall the famous lines of the song of Hemanta Mukherjee-O Nodi Re Ekti Kotha Shudhai sudhu tomare,bolo kothai tomar desh,tomar nei ki cholar shesh.Tomar kono badhon nai,tumi gharchara ki tai.....
ReplyDeleteYes, indeed. The song resembles the writing.😊
DeleteApurbo likhecho. Temoni chabi gulo. Khub sundor bhabe nadir moner katha bukti korecho. Aro likhe jao.
ReplyDeletethank you.
Delete