অসীম অক্ষয়!





জীবনের অর্থ অন্বেষণে মানুষ সর্বদাই সচেষ্ট। চারপাশে তাকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু জীবনের বড় উদাহরণ হলো মাথার ওপরের আকাশ যা আদি অনন্ত কাল ধরে অবস্থান করছে। অনন্ত বিস্তৃত আকাশ যার কোন আদি নেই, অন্ত নেই, সীমা পরিসীমা নেই, যে সব সময় আমাদের মাথার ওপর থেকে আমাদের রক্ষা করছে। আকাশের বুকে কত পাখি, কীট পতঙ্গ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ তারা জানে আকাশ হলো সেই ভূমি যেখানে তারা নিরাপদ, কোনো হৈ হট্টগোল নেই, কোনো ভিড়ভার নেই, ট্রাফিক সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। যে যার ইচ্ছে মতো, নিজের খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বাধা দেবার কেউ নেই, কেউ কাউকে বিরক্ত করে না বা কেউ কারোর রাস্তা আটকায় না। বিভিন্ন ঋতুতে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপের সাথে আকাশেরও বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। গ্রীষ্মের উষ্ণতা, বর্ষার বৃষ্টি, শরতের মেঘ, শীতের শীতলতা, বসন্তের হাওয়া এই সবেরই রূপের প্রতিফলন আকাশে দেখতে পাওয়া যায়।

একই আকাশে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র সবাই একসাথে সহাবস্থান করে নিজের নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। দিনের বেলা সূর্য আর রাতে চাঁদ ও তারারা আকাশে থেকে তাদের নিজস্ব কিরণ দিয়ে সমগ্র জগৎ কে আলোকিত করে, জগৎ কে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই আকাশ প্রকৃতির সমস্ত ঝড়, ঝঞ্ঝা, বিদ্যুৎ, বজ্রপাত এর উৎপাত, অত্যাচার নিজের বুকে সহ্য করে নেয়; অথচ কাউকে কোন দোষারোপও করে না। তার নীরবতা এটাই বোঝায় যে এটাই যেন তার কর্তব্য এবং তার সৃষ্টি হয়েছে এই সব উৎপাত সহ্য করার জন্য। আর এইসব কারণে আমরা যেন আরও বেশী করে আকাশের গুরুত্ব অনুভব করি। কবি, সাহিত্যিক, লেখক, শিল্পী সবাই আকাশ কে দেখে তার প্রসারতা, বিস্তৃতি অনুভব করে কত অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস রচনা করেছে। এই সব সৃষ্টিও যেন আমাদের আকাশকে প্রতিবার নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জনের দৃষ্টি দিয়ে আমরা তার সাথে বিভিন্ন ভাবে পরিচিত হয়ে চলেছি।

আকাশের বুকে মেঘেদের আনাগোনা তাকে এক অনবদ্য রূপ প্রদান করে। আকাশে প্রতি মুহূর্তে মেঘেরা একে অপরের সাথে মিলে মিশে বিভিন্ন নকশা এঁকে চলেছে। তারা এমনভাবে একে অপরের সাথে খেলা করে যে একই নকশা দ্বিতীয় বার আর দেখা যায় না। কখনও কল্কা, কখনও কোনও প্রাণী, কখনও মানুষ আবার কখনও কোনও বিমূর্ত কলা। তারা যেন বিভিন্ন সময়ে তাদের মনের অবস্থার ছবি এঁকে চলেছে যেগুলো বিশ্লেষণ করলে হয়তো তাদের সুখ দুঃখের কোনও গল্প শোনা যেত। তাদেরও জীবন সংগ্রামের উত্থান পতনের কোনও গাথা পাওয়া যেত। মেঘেদের আনন্দ, বিষাদ, সুখ, দুঃখ সবকিছুরই প্রতিফলন বিভিন্ন নকশার মাধ্যমে তারা যেন বার্তা দেয় আমাদের। এই মেঘের রাশি আকাশের বুকে অবস্থান করে আকাশের সৌন্দর্যতায় এক আলাদা মাত্রা এনে দেয়, নইলে মেঘের অনুপস্থিতিতে আকাশ যেন ফুল বিহীন বাগান মনে হতো।

আকাশের দিকে তাকালে মনের মধ্যে এক মহা বিশ্বের অনুভূতি হয়। নিজেকে এক অনন্ত বিশ্ব সংসারের সদস্য বলে মনে হয়। তখন চারপাশের সমাজ, পরিবেশ, পরিবার সব অত্যন্ত ক্ষুদ্র, সামান্য, তুচ্ছ লাগে। আকাশের অসীম ব্যাপ্তির সামনে নিজেদের অত্যন্ত নগন্য মনে হয়। মনে হয় আমরা কত সামান্য, অর্থহীন ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করি, রেষারেষি করি, হিংসায় লিপ্ত হই যার কোনও ভালো পরিণতি নেই। আকাশের প্রসারতা আমাদের নিজেদের জীবনের মানে খুঁজতে সাহায্য করে, তার মতো উদার হতে শেখায়। আকাশের বুকে অবস্থিত মেঘরাশি সবসময় মনে করায় যে সবকিছু পরিবর্তনশীল। তাই সুখে আনন্দে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই, আবার দুঃখে ভেঙে পড়ার দরকার নেই। কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়; আজ যা আছে কাল তা নাও থাকতে পারে, আবার আজ যা নেই কাল তা হতেও পারে। মেঘ আমাদের জীবনের চড়াই উৎরাই এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে শেখায়।

আকাশ আমাদের এক ঐক্যতার বার্তা দেয়। একই আকাশের নিচে আমরা সবাই অবস্থান করছি। তাও যতই নিজেদের মধ্যে রাগ, বিদ্বেষ, হিংসা পোষণ করি না কেন বাস্তবে আমরা একই ছাদের তলায় রয়েছি, একই আশ্রয়ের বাসিন্দা। আমরা যেখানেই যাই না কেন বা চারপাশে যাই হোক না কেন আকাশ কখনও মাথার ওপর থেকে সরে যায় না, সে সবসময় আমাদের সাথে থাকে। তার বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে সে আমাদের সাথে কথা বলে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সাদা, কালো বিভিন্ন রং দিয়ে তার বিভিন্ন বার্তা প্রতিমুহূর্তে সে আমাদের দিয়ে চলেছে। এই বিভিন্ন রং যেন আমাদেরই মনের বিভিন্ন রূপের প্রতিফলন। সাদা রং যেমন বিশুদ্ধতার পরিচয় দেয়, তেমন হলুদ রং মৈত্রী ভাব আনে; আবার লাল রং দেখে যদি রাগ বা বিদ্বেষ অনুভব হয়, সাথে সাথে ভালোবাসার কথাও মনে করায়। তাই আকাশের বিভিন্ন রঙের সাথে আমরা নিজেদের মনের বিভিন্ন অবস্থার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দেখতে পাই। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমরা যাই না কেন আকাশ আমাদের সাথে সবসময় থাকে। তার বিভিন্ন রং, রূপ দিয়ে সে সর্বদা আমাদের মনোরঞ্জন করে চলেছে, আমাদের ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছে এবং জীবন পথে চলার প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। আকাশ হলো এক অক্ষয় সৃষ্টি যে তার বিশালতা নিয়ে সময়ের শুরু থেকে স্বমহিমায় বিরাজমান

নিঃসীম ঘননীল অম্বর
গ্রহতারা থাকে যদি থাক নীল শূন্যে
হে কাল, হে গম্ভীর
অশান্ত সৃষ্টির
প্রশান্ত মন্থর অবকাশ 
হে অসীম উদাসীন বারোমাস ...



ডঃ ঋতুপর্ণা বসাক

7 comments:

  1. Ki bolbo..... Tomake bolar moto vasha nai...
    Sudhu Boli AWESOME

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ লিখেছিস। লেখা টা ছাড়িস না। চর্চা কর।

    ReplyDelete
  3. Akasher motoi Asim r swaccho lekha..

    ReplyDelete

শ্রোতা ও বক্তা

  শ্রোতা ও বক্তা শব্দ দুটো নিজেরাই নামের মধ্যে নিজেদের চারিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করে দেয়। একজন বলে একজন শোনে। যে বলে সে বক্তা, আর যে শোনে সে ...

Popular Posts