"বিন্দু বিন্দু জলে সিন্ধু" - এক একটা জলবিন্দুর মিলিত প্রয়াসের সৃষ্টি হল এই সমুদ্র। এক সমগ্র প্রচেষ্টার মিলিত পরিণাম কি সুন্দর হতে পারে সমুদ্র তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। প্রতিটা জলবিন্দু তার নিজস্ব সত্ত্বাকে নিষ্ক্রিয় করে এই বিশাল সক্রিয় সমুদ্র ভান্ডার তৈরী করেছে। দলের তেজস্বিতার এক অভূতপূর্ব নিদর্শন হল এই সমুদ্র। একটা জলবিন্দুর মধ্যে সমগ্র সমুদ্রের রহস্য বর্তমান।
সমুদ্রের দিকে তাকালে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে একটা দিগন্ত বিস্তৃত রেখা যেখানে আকাশ আর সমুদ্র একে অপরের সাথে মিশে গেছে। দুজনেই নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো অক্ষুন্ন রেখে একে অপরের সাথে মিলিত হয়েছে। দুজনেই নিজেদের রং, স্বভাব, কার্যকারিতা সব বজায় রেখে দিগন্তের মঞ্চে এক কাল্পনিক রেখা তৈরী করেছে যেখানে দুজনেরই সমান কৃতিত্ব রয়েছে।
সমুদ্রের বিশাল জলরাশি আদি অনন্ত কাল ধরে সীমাহীন ভাবে বিস্তৃত। সমুদ্রের ওপরের ঢেউ যত বেশি উদ্দাম, প্রানোচ্ছল তার নীচের জল তত বেশি শান্ত আর গভীর। একই সমুদ্রের দুই বিপরীত চিত্র। ওপরের ঢেউ এর তারতম্য নীচের গভীরতায় কোনো রকম প্রভাব ফেলে না। তপস্যা বোধহয় একেই বলে - ওপরের ঝড় ঝাপটা ভেতরের চিত্তকে কোনোভাবেই বিচলিত করতে পারে না।
সমুদ্রের ঢেউগুলি কত লক্ষ মাইল ঘুরে এসে তটে আছড়ে পড়ছে, যেন একটা যাত্রা পূর্ণ করল। আবার নতুন যাত্রা শুরু; বিভিন্ন দেশ মহাদেশ ঘুরে আবার কোনো তটে আছড়ে পড়বে। আর এই তটও যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে তার যাত্রীর যাত্রা পূরণের। মাঝে মাঝে মনে হয় কার জন্য বেশি দুঃখ করবো - সমুদ্রের ঢেউ যে কোনোদিনও থামতে পারবে না; না কি সমুদ্রতট যে কোনোদিনও চলতে পারবে না। নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস!
সমুদ্র আমাদের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। যখনই গভীরতার প্রশ্ন আসে সমুদ্রকে তার সবথেকে বড় উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জীবনের চড়াই উৎরাইকে লেখক কবিরা সমুদ্রের সাথে তুলনা করেছেন। তাদের মতে জীবনে সমুদ্রের মতো যেমন ঢেউ আছে তেমনই মুক্তোও আছে। সেই মুক্তো পেতে গেলে যেমন সমুদ্রের গভীরে ডুব দিতে হয়, ঠিক তেমনই জীবনের লক্ষ্য পেতে হলে তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়; তবেই সাফল্য আসে।
সমুদ্রের ওপরটা দেখে সমুদ্রকে বিচার করাটা চরম বোকামি। এর গভীরে যে রত্ন ভান্ডার রয়েছে, অন্য যে জগৎ বিরাজমান তা ওপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এই জগতের জলজ প্রাণীরা, সুন্দর ভাবে তাদের জীবন যাপন করছে। কত মানুষের জীবিকা এর ওপর নির্ভর করে। অনেক আবিষ্কার ও ধ্বংসের সাক্ষী এই সমুদ্র। কারও হয়তো সবকিছু কেড়ে নিয়েছে, আবার কাউকে হয়তো রত্ন পাইয়ে ভরে দিয়েছে। একই সমুদ্রের আশীর্বাদ ও অভিশাপ বিভিন্নজন বিভিন্ন ভাবে পেয়েছে।
মুক্তো সমুদ্রের ধারে নয়, সমুদ্রের মধ্যে পাওয়া যায়। তাকে পেতে গেলে সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিতে হয়, সমুদ্রের ধারে খুঁজতে নেই। তবেই প্রাপ্তিযোগ হয়। পরীক্ষা সবাইকে দিতে হয়। বিনা পরীক্ষায়, বিনা পরিশ্রমে কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। বিনা পরিশ্রমে প্রাপ্ত জিনিসের মূল্য থাকে না। বিন্দু বিন্দু জলরাশিকে একসাথে ধরে রেখে সমুদ্র যেমন নিজে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা দিচ্ছে, ঠিক তেমনই তার কাছ থেকে মুক্তো উদ্ধার করার ক্ষেত্রে সেও অন্যের পরীক্ষা নিচ্ছে।
একটাই নীল সমুদ্র তার কত রঙের বৈচিত্র্য; কোথাও গাঢ় নীল, কোথাও হালকা, কোথাও আকাশী রং। ওপরের রঙ এ বিভিন্নতা থাকলেও নীচের বৈশিষ্ট্য এক এবং অভিন্ন। ওপরের জল যতই অপরিষ্কার হোক না কেন, যত ভেতরে যাওয়া যায় জল ততই স্বচ্ছ, পরিষ্কার ও শীতল। ওপরের ঢেউয়ের এই উদ্দাম প্রানোচ্ছলতা আমাদের দিকের সন্ধান দেয়, আর নীচের গভীরের শান্ত প্রকৃতি সেই দিকের পথে চলার চিন্তা ও শক্তি জোগায়।
সমুদ্র কোনো বস্তু নয়, এটা একটা অনুভূতি। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ আমাদের সাথে খেলা করে, আমাদের শরীরের ও মনের প্রতিটি অংশকে তার অস্তিত্বের সাথে পরিচয় করায়। কথায় বলে যে কোনো কিছুর প্রতিকার হল লবণ জল, ঘাম, চোখের জল অথবা সমুদ্র। সমুদ্রতটে দাঁড়ালে তার ঢেউগুলো আমাদের পা ধোয়ার সাথে সাথে মনকেও ধুয়ে পরিষ্কার করে দেয়; সে আমার আমিকে চিনতে শেখায়। আমাদের একই সাথে ক্ষুদ্র, বিনয়ী ও উদ্বুদ্ধ করে তোলে। সে যেন কানে কানে বলে "যদি তুমি জীবনের ছোটো ছোটো সাধারণ জিনিষে আনন্দ খুঁজে পাও, সেটাকে উপভোগ করো, তবে জীবনকে বাঁচা ও তার মানে বোঝা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়।" আমাদের জীবনও সমুদ্রের মতো মুহূর্তে মুহূর্তে বিভিন্ন রং বদলায়; কখনও সাদা কখনও কালো, কখনও খারাপ কখনও ভালো। দৈনন্দিন জীবনে যখন আমরা হাঁপিয়ে উঠি তখনই মনে হয় "এমন কোথাও যাই যেখানে সূর্য, চন্দ্র নীচে নেমে এসে ধরিত্রীকে চুম্বন করে। আর সেই মিলনের শিহরণ আমাদের শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে প্রবেশ করে আমাদেরকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তুলুক।" আসলে আমাদের জীবনও এক সমুদ্র - কখনও শান্ত, স্থির, আবার কখনও কঠিন, দুর্গম; কিন্তু পরিশেষে সবসময় এটা একটা সুন্দর বাস্তব।
ড: ঋতুপর্ণা বসাক
খুব সুন্দর
ReplyDeletethank you.
Deleteঅপুর্ব
ReplyDeletethank you.
DeleteEk kothai apurbo-Rusati Banerjee
ReplyDeletethank you Rusati..:)
DeleteExcellent, Unparalal, likhe jao
ReplyDeleteThank you..
Deleteতোমার বাবা আমাকে হোয়াটস অ্যাপে পাঠালেন l পড়ে মুগ্ধ হলাম l আবারও পড়ব প্রিন্ট করে নিয়ে l আরও লেখো l ভালো থেকোl
ReplyDeleteধন্যবাদ। 🙏🏻😌
DeleteGreat writing ❤️
ReplyDeleteThank you...:)
Deleteখুবই মনগ্রাহী লেখা - সমুদ্রের বিশালতা- ভয়াবহ রুপ সবাই দেখে - নোনা জল দেখে - কিন্ত কজন তার রত্নগর্ভা র দিকটা বিচার করে - শুভেচ্ছা রইল
ReplyDeleteধন্যবাদ 🙏🏻😊
DeleteKhub mon chuye jaoa sekhar golpo.besh valo laglo
ReplyDeleteThank you 🙏
Delete