সুখ দুঃখের কান্না

 




আচ্ছা, হঠাৎ করে কোনসময় চারপাশের লোকজন, হইহট্টগোলের মাঝে নিজেকে একা মনে হয়? সব কিছু ফাঁকা মনে হয়? মনে হয় যে সব আছে কিন্তু কিছু নেই? খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাঁদতে পারি না পাছে কেউ শুনে নেয়? মনে হয় কাউকে জড়িয়ে কাঁদতে পারলে খুব ভালো হতো? মনে হয় যদি কেউ থাকতো যার কাছে কেঁদে নিজের কষ্ট ভাগ করে হালকা হওয়া যেত? হঠাৎ কোন বিষন্ন দুপুরে মন ভারী হয়ে ওঠে? কখনও অতীতের কোন স্মৃতি এসে হঠাৎ করে দমকা হাওয়ার মতো ঝাপটা মারে? বুকের ভেতরটা কষ্টে ভেঙে চুরে যায়? গভীর নিঃশব্দ কোন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে অবসাদ গ্রাস করে? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে? সব ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়? 

আঘাতের পর আঘাত এসে একসময় মানুষকে চুপ করিয়ে দেয়। কান্নাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে গলা বুজিয়ে দেয় যেখান থেকে আর কোন আওয়াজ বেরোয় না। চেনা অচেনার দ্বন্দ্বে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে সম্পর্কগুলো হারিয়ে যায়। আর তার সঙ্গে হারিয়ে যায় তাদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। একসময় যাদের সঙ্গে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটতো আজ তাদের সঙ্গে নূন্যতম যোগাযোগটুকুও নেই। প্রিয় থেকে অপ্রিয়, প্রিয়জন থেকে প্রয়োজন, গুরুত্ব থেকে বিরক্ত পরিবর্তনগুলো মানুষকে একাকীত্বের ঘেরাটোপে আবদ্ধ করে ফেলে। নিঃসঙ্গতার ধুম্রজাল ক্রমশঃ মানুষকে আরও  শক্ত করে বেঁধে ফেলে যেখানে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন কান্নাই একমাত্র তাদের সেই একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে ওঠে

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেই বেড়াজাল ভেদ করতে সক্ষম হয়, সেইসব অনুভূতিগুলোও চলে যায় কিন্তু স্মৃতিগুলো থেকে যায় যেগুলো অযাচিতভাবে মাঝে মাঝে বর্তমানে হানা দেয়। আর সেই কথাগুলো মনে পড়লে বর্তমানের সুন্দর মুহূর্তগুলো বিষন্নতায় ভরে যায়, আর তখন মানুষ কেঁদে ওঠে। সেই কান্নাগুলো সেই মুহুর্তে দরকার কারণ মনের ভেতরের কষ্টটা বেরিয়ে গেলে সেই ফাঁকা জায়গায় ভালো স্মৃতি এসে জমা হয় এবং মানসিক শান্তি দেয়। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে ভেতরে কষ্ট চেপে রেখে, কান্না গিলে মুখে হাসি নিয়ে থাকাটা খুবই ক্ষতিকারক। এতে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যেরও সাম্যতার ভিত নড়ে যায়। তাই নিজেকে ঠিক রাখতে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ রাখতে কান্না দরকার।

মেঘ জমে ঘনিভূত হলেই বৃষ্টি নামে। হৃদয়ে কষ্টের মেঘ জমলে হৃদয় সবসময় সেই ভার বহন করতে পারে না এবং অনেক সময় শব্দেও প্রকাশ করতে পারে না তখন কেঁদে সেই মেঘ হালকা করা দরকার। কাঁদা মানে দুর্বল তা নয়, বরং দীর্ঘকাল শক্ত থাকার পরিণাম হল কান্না। প্রতিনিয়ত লড়াইয়ে জয় পরাজয়ের খেলায় ক্লান্ত হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। আর লড়াই করতে করতে কখনও কখনও বিধ্বস্ত হয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কারণ কোথাও প্রতিটা যোদ্ধার ভেতর মনের গভীরে সবাই শিশু, আর সেই শিশুও কখনও ভয় পায়, কেঁদে ওঠে, কাউকে আঁকড়ে ধরতে চায়। নিজের সব কষ্ট ভেতরে জমিয়ে রেখে নিজেকে শক্তিশালী দেখালে সেটা নিজেরই ক্ষতি করা হয়। এইভাবে কষ্ট চেপে রাখলে সেগুলো জমে পাথর যায়, মন অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ে যেখানে আর কোন অনুভূতিই কাজ করে না যেটা অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়। তাই নিজের ভেতরের কষ্ট বের করে নিজেকে আর শক্তিশালী বানাতে কান্নাটা একদম সঠিক উপায়

ভালো খারাপ মিশিয়ে একটা মানুষ। এটা একটা প্যাকেজের মতো। যদি একবার একটা প্যাকেজ পছন্দ করে নেওয়া হয় তবে তার খারাপ ভালো সব মিলিয়েই তাকে গ্রহণ করতে হয়। তাই একজন সবসময় শুধু হাসবে, খেলবে, দৌড়োবে এটা হয় না। দুঃখে কষ্টে সেও ভেঙে পড়তে পারে আর সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই হওয়া উচিৎ। ভেঙে পড়লে তবেই উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখা যায়, কষ্ট পেলে আনন্দর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়, কাঁদলে হাসির মর্ম বোঝা যায়। যত কষ্ট, দুঃখ, কান্না এসবের সম্মুখীন হয় তত আনন্দ, খুশি এদের পাওয়ার চেষ্টা তীব্র হয়। এটা জীবন যেখানে এই চড়াই উৎরাই এর মধ্যে দিয়েই যেতে হয়। আর আমরা যন্ত্র নই, মানুষ যেখানে কেউই নির্ভুল হয় না।

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং সবাইকে নিয়ে সমাজে চলতে হয়। অনেকসময় সবার সামনে কাঁদা সম্ভব হয় না কারণ সেই কান্না দেখলে অনেক মন ভেঙে যেতে পারে, অনেক বিশ্বাস, ভরসা হেরে যেতে পারে। তাই কখনও কখনও বৃষ্টির জলে, স্নানের সময় ঝর্ণার কলের জলের সঙ্গে কান্নার জল ভেসে যায়। বিদ্যুতের আওয়াজ বা কলের জলের আওয়াজে আসল কান্নার আওয়াজ চাঁপা পড়ে যায়। এর সুবিধা হল কান্নাটাও হল অথচ কেউ জানতে পারলো না যেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল। কখনও কখনও খেলায় পুনরায় ফিরতে হলে বা নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করতে হলে কান্নাটা বিশেষভাবে প্রয়োজন

বেঠিক থেকে ঠিক দেখানোটা একেবারেই সঠিক নয়। সময় খারাপ হতেই পারে, তার জন্য মন খারাপও হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মনখারাপকে অস্বীকার করে নিজেকে ঠিক দেখানোটা অস্বাভাবিক কারণ এটা ভেতরে ঘুণ পোকার মতো ক্ষতি করতে থাকে। মন খারাপ দূর করার জন্য, কষ্ট কমানোর জন্য যদি কাঁদতে ইচ্ছে করে তবে কেঁদে নেওয়া ভালো। এতে মন হালকা হয়। কষ্ট দুঃখ এগুলো জমিয়ে তালাবন্ধ করে রাখলে মনপল্লীতে গুমোট একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কান্নার পর সেই গুমোট ভাব কেটে গিয়ে সেই পল্লীজুরে প্রশান্তির পবন বয় যেটা এক নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটায়। সেই নতুন উৎসাহ, উদ্দীপনা নতুন করে বাঁচার মন্ত্র শেখায়। তাই মন পরিষ্কার করতে কখনও কখনও কাঁদা দরকার। 

দুঃখেই যে শুধু কান্না পায় তা তো নয়, আনন্দেও কান্না পায়। অনেক কষ্টের পর কিছু পাওয়া বা অপ্রত্যাশিত ভাবে জীবনে ভালো কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনা মানুষকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। আর সেই আবেগ ঘণিভূত হয়ে গেলে কান্নার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে, আর তার সঙ্গী হয় মুখের হাসি। এই কান্নার অর্থ হল কোন না কোন সময় খুশি সবার জীবনে আসে, ভালো সবার জীবনে ঘটে। আনন্দের কান্না এটাই মনে করায় যে কষ্টের মধ্যেও আনন্দের ঝলক পাওয়া যায়, আর বলাবাহুল্য জীবনের সেই দামি মুহূর্তগুলো খুব আবেগপূর্ণ হয়। কারণ এই আনন্দের কান্নাগুলো অনেক অনুচ্চারিত খুশি বা অনেক অদৃশ্য কষ্টের এবং তার সঙ্গে অনেক নীরব লড়াইয়ের সাক্ষ্য বহন করে

কখনও কখনও কোন কারণ ছাড়াই কান্না পায়। হয়তো চেতন মনে উপলব্ধ হয় না বলে বোঝা যায় না কাঁদার কারণটা কি। কিন্তু অবচেতন মনে কোথাও হয়তো সে কারণটা রয়ে যায় যেখান থেকে কান্নাটা আসে। আর সেটা এলে তাকে বের করে দেওয়াই ভালো নয়তো এটাই ভেতরে বাসা বেঁধে এগোনোর পথে বাঁধা দেয়। তাই যত তাড়াতাড়ি এটাকে বার করে দেওয়া যায় ততই স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। তাই অকারণেও যদি কান্না পায় তো কেঁদে নেওয়া ভালো। কথায় আছে কখনও কখনও হাসি যেটা পারে না কান্না সেটা করে দেখিয়ে দেয়। এটা তখন একটা মহৌষধির কাজ করে।

" Tears are the cleansing rain that washes away the pain and allows a new beginning to emerge."

                                    ---Unknown

ড: ঋতুপর্ণা বসাক



4 comments:

  1. 🙏🙏🙏👏👏👏👏👏👏👏

    ReplyDelete
  2. Kokhono okaronei monkharap lage ...tar kono karon khujleo paowa jayna... Abar kokhono khuje peleo nijer meki self-respectr acchadone"ami kano kandbo kandar to kono karon nei " ai vebe kannata chepe rakhi...asole amra bujhtei parina j amra kotota durbol ba bujhte chaina..boyos barar sathe sathe mon kharaper karon barche sathe komche somoy tai mon kharapr karon khojar moto somoy amader nei ..amra nijei nijer kache oporichito hoye uthchi

    ReplyDelete

শ্রোতা ও বক্তা

  শ্রোতা ও বক্তা শব্দ দুটো নিজেরাই নামের মধ্যে নিজেদের চারিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করে দেয়। একজন বলে একজন শোনে। যে বলে সে বক্তা, আর যে শোনে সে ...

Popular Posts