Sunday, December 18, 2022

বাঁক

 

বাঁক শব্দটি প্রতি মুহুর্তে এক অদ্ভুত কৌতূহল বা রোমাঞ্চ নিয়ে আসে, তা সে রাস্তার বাঁক হোক বা জীবনের বাঁক। প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে থাকা আকস্মিকতা যে কোন মুহুর্তে যাত্রার মোড় ঘুরিয়ে অন্য এক নতুন দিশার দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাস্তার বা নদীর বাঁকের মতো জীবনের প্রতিটি বাঁকও আকস্মিক আর অপ্রত্যাশিত হয়

জীবন মাঝেমধ্যেই সঠিক অভিমুখে এক আকস্মিক ভুল বাঁক নেয় যা তাকে এক অন্য দিকে নিয়ে যায়। আবার কখনও ভুল পথে সঠিক বাঁক নিয়ে জীবন এক অপ্রত্যাশিত বাস্তবের সামনে এসে দাঁড়ায় বা ভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। জীবন একটা রাস্তার মতো যেখানে প্রতিটি বাঁকে কোন না কোন রোমাঞ্চ লুকিয়ে আছে

বাঁক কখনও রুক্ষ শুষ্কতা এনে জীবনকে একটা কঠিনতার মুখোমুখি দাঁড় করায়; আবার কখনও বাঁক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই কঠিনতা কোন বিশল্যকরণীর ছোঁয়া পেয়ে নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। জীবন মাঝে মধ্যে কোন কোন বাঁকে এই ভাবে জাগিয়ে তোলে

এক বিখ্যাত উক্তি হলো "রাস্তার মোড় কখনোই একটা রাস্তার শেষ নয় যতক্ষণ না কেউ রাস্তার বাঁক নিতে অসমর্থ হয়"। কেউ যদি ভাবে যে রাস্তাটা সবসময় সরলরেখার মতো সোজা হবে, তাতে কোন বাঁক আসবে না তবে সে জীবনের সবথেকে বড় অনভিজ্ঞ যাত্রী তৈরী হবে। জীবনে যত ঘাত প্রতিঘাত আসবে, যত বাঁক আসবে তত প্রতিকূলতার সঙ্গে মানাতে পারবে, তত নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চার হবে এবং অভিজ্ঞ যাত্রী হিসাবে প্রমাণিত হবে।

যাত্রাপথে যখনই বাঁক আসবে তখন সেই পথে এগিয়ে যেতে হয়; কারণ এটা মনে রাখতে হবে যে এক একটা যাত্রাপথ একটা অভিযান যেখানে একমাত্র এগিয়ে গেলেই কোন লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে, নতুন দিশার সন্ধান পাওয়া যাবে। জীবনের পথে উপস্থিত এই বাঁকই হয়তো নতুন কোন লক্ষ্যে নিয়ে গেলো যা কারও কল্পনার অতীত ছিল। এই বাঁকের জন্যই আবার নতুন রূপে নতুন করে সব পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সামান্য থেকে বিশেষ আর শূণ্যতা থেকে পূর্ণতা প্রাপ্তি হয়। তাই জীবনের কিছু বাঁকে জেগে উঠতে হয়, নির্ভয়ে এগিয়ে যেতে হয়।


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, November 13, 2022

মনের ভাব


মন বড় অদ্ভুত এক সৃষ্টি যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়। কখনও রাগ, কখনও দুঃখ, আবার কখনও ভালোবাসা, আনন্দ - মনের এই বিভিন্ন ভাব পরিবেশ ও পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়।

মনের এই ভাবের পেছনে বিজ্ঞানীরা হয়তো বিভিন্ন জীবতত্ত্বের ব্যাখা দিয়েছেন; কিন্তু কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে সেগুলো বিভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ হয়ে ধরা দিয়েছে। এইসব অনুভূতি লাল, নীল, গোলাপি, সবুজ, কালো ইত্যাদি বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে। একই ভাব একই সময়ে ভিন্ন ভাবে ভিন্ন লোকের কাছে ধরা পড়েছে - কারও কাছে ভালোবাসা তো কারও কাছে ভালোলাগা, আবার কারও কাছে বিরহ।

প্রত্যেকেরই মন আছে আর তার সাথে আছে সেই মনের বিভিন্ন অনুভূতি। জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে সৃষ্ট সেই অনুভূতিগুলি প্রত্যেকেই অনুভব করে এবং বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের কাছে তা প্রকাশ করে। কারও কাছে ভালোবাসা, আনন্দ, কৃতজ্ঞতা আবার কারও কাছে রাগ, ঘৃণা, ভয় - বিভিন্ন রূপে এরা প্রকাশিত হয় যা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সেই সময়ের পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং ব্যক্তিবর্গের ওপর।

একজনের মন যদি আর একজনের মনের সাথে মিল খুঁজে পায় তবে ভবিষ্যতেও সেই মনের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করে। আর যদি অন্য মনের সাথে মিল খুঁজে না পায় তবে সেই সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী হয় সেই মন এই মনের ভাবের ভার বহনে অক্ষম। সবাই ভার কমাতে চায়, বইতে বা বাড়াতে নয়। এক ভাব কমলে বা দূর হলে তবেই অন্য ভাবের উদয় হয়।

একজন মানুষ যখন তার মনের ভাবের ভারে বিহ্বল হয়ে পড়ে সে সেই ভাবের ভার কমানোর জন্য অন্য কাউকে খোঁজে এবং তাকে সেটা দিয়ে দেয়। একজনের মন আরেকজনের মনের ভাবের রঙে রাঙায়িত হয়ে কখনও আনন্দে মেতে ওঠে, কখনও দুঃখে কেঁদে ওঠে, আবার কখনও রাগে গর্জন করে ওঠে। প্রতিনিয়ত এক মন তার ভাব প্রকাশের জন্য আর এক মনকে খুঁজে চলেছে।



ঋতুপর্ণা বসাক

Monday, October 31, 2022

উৎসব



'উৎসব' নামের মধ্যেই এক খুশীর ঢেউ খেলে যায় মনের মধ্যে। উৎসব মানে আনন্দ, ভালোলাগা, সমৃদ্ধি। উৎসব মানে মনের মিল, প্রিয়জনের দেখা পাওয়া, সব কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে ওঠা। সবাইকে এক হওয়ার, কাছাকাছি আনার, দূরত্ব মেটাবার মাধ্যম হলো উৎসব। উৎসবে সবাই অশুভ সব মিটিয়ে শুভ কে আহ্বান করে নতুন পথ চলার অঙ্গীকার করে। 

উৎসব মানেই বৈচিত্র্য যেখানে বিভিন্ন রং, ধর্ম, জাতি, দেশ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, নিজস্ব বৈশিষ্ট্যতা হারিয়ে এক নতুন সৃষ্টিতে সবাই যোগদান করে। প্রত্যেকে উৎসবের তার নিজস্ব মাহাত্ব আছে যা অন্য আর এক উৎসব থেকে তাকে আলাদা করে। প্রতিটি উৎসবের নিজস্ব ইতিহাস, আচার আচরণ, বৈশিষ্ট্য আছে যা একটি দেশের বা সমাজের সংস্কৃতির ধারক হিসাবে কাজ করে।

উৎসব মানেই স্মৃতি। বছর বছর একই উৎসব বিভিন্ন স্মৃতি তৈরী করে যা আগামী দিনে বেঁচে থাকার ভালো থাকার রসদ জোগায়। আবার কখনও বা অতীতের কোন বেদনাদায়ক ঘটনা দুঃখের স্মৃতি বহন করে আনে যা কষ্ট দেয়, পুরোনোকে মনে করায়। উৎসব মানেই ভালো খারাপ মিলিয়ে এক নতুন মেলবন্ধন যেখানে সবাই পুরোনোকে সঙ্গী করে নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়।

উৎসব একটা আবেগ যা সবার মধ্যে বিদ্যমান; কারণ এই উৎসবেই সবাই সারা বছরের ক্লান্তি দূর করে একে অপরের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিযোগিতার চাপে হারিয়ে যাওয়া মানুষরা উৎসবের মধ্যে দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস নেয়, নিজের অনুভূতিগুলো অনুভব করে, নিজের সাথে এবং সবার সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। তাই হয়তো সারা বছর সবাই তাদের এই প্ৰিয় উৎসবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। উৎসব হলো সব ধার্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মনোভাবের মিলনক্ষেত্র


ঋতুপর্ণা বসাক

Tuesday, October 18, 2022

সময়, এইসময়, ঐসময়, সুসময়, দুঃসময় - সবসময়

সময় সৃষ্টির বড়ই অদ্ভুত এক আবিষ্কার যা আমাদের সবকিছুর সাথে পরিচয় করায়, মানিয়ে নিতে শেখায়। সময় প্রতি ক্ষণে আমাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে শেখায়। আজ যা আছে কাল তা নাও থাকতে পারে। আজকের পরিবেশ কাল পরিবর্তন হয়ে যেতেও পারে। সময়ের হাত ধরেই সবাই শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন, যৌবন থেকে বার্ধক্যে উপনীত হয় এবং পরিশেষে অন্তিম যাত্রার পথিক হয় । সবই সময়ের ব্যাপার।

ভালো সময় সবাই চায় কারণ তখন সব ভালো হয় - সমৃদ্ধি, উন্নতি, প্রশংসা, প্রিয়জন সব পাশে থাকে। আর খারাপ সময় মানেই এগুলির অনুপস্থিতি। কিন্তু খারাপ সময়ের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হল সে প্রকৃত বন্ধু চিনতে শেখায়। ভালো সময়ে তোমার কাছে সব আছে, তোমার থেকে সবাই নেবে, তাই তোমার পাশে থাকে। কিন্তু খারাপ সময়ে তোমার কাছে কিছু নেই, তোমাকে দেবে বা সাহায্য করবে। আর সেটা কতজন করে সেটাই খারাপ সময় চিনতে শেখায়।

সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার গতিতেই চলে। প্রতিটি সময়ের নিজস্ব দাম আছে। সঠিক মুহুর্তের জন্য অপেক্ষা না করে প্রতিটি মুহুর্তকে কাজে লাগানোই সঠিক সিদ্ধান্ত। সময়কে কেউ ধরে রাখতে পারে না কিন্তু সেটাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করে তার গুরুত্ব বাড়াতে পারে। কারণ একবার যে সময় চলে যায় তাকে হাজার চেষ্টা করেও ফিরে পাওয়া যায় না। তাই যে সময় বর্তমানে উপস্থিত তাকে ভালো ভাবে উপভোগ করতে হয়, নয়তো পরে আফসোশ করতে হয়।

এটা ঠিক সময় বহমান, তার ওপর কারও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে সেই সময়কে কিভাবে কাজে লাগানো হবে সেটা নির্ভর করে মানুষের ওপর। প্রতিটা মানুষ সবচেয়ে বেশি যেটা চায় সেটা হল সময় কিন্তু সবচেয়ে বেশি সেটাই সে নষ্ট করে। যে মানুষ যতটা ভালো ভাবে সময়কে কাজে লাগাতে পারবে তার কাছে সময় ততটাই সুহৃদ হয়ে উঠবে। আর এই ব্যবহৃত সময়ই ভবিষ্যতে বিভিন্ন সুখ দুঃখের স্মৃতি বহন করে। ভালো ভাবে কাজে লাগালে তা সুখকর স্মৃতি আনবে, আর ভুল ভাবে কাজে লাগালে দুঃখ হবে এবং নতুন শিক্ষা পাবে ।

সময়ের বিস্তার সর্বত্র। স্বয়ং ঈশ্বরও সময়কে বাদ দিয়ে চলতে পারেন না। সেখানে প্রতি মুহুর্তে জগতে সময়ের প্রভাব অসীম। তা সে এক সেকেন্ড, এক মিনিট, এক দিন, এক মাস, এক বছর - যাই হোক না কেন। প্রত্যেকের নিজস্ব গুরুত্ব আছে। সময় খুব সুন্দরভাবে জীবনে যেটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ সেটা দেখিয়ে দেয়। সম্পর্কের সমীকরণগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। প্ৰিয় থেকে অপ্রিয়, প্রিয়জন থেকে প্রয়োজন, গুরুত্ব থেকে বিরক্ত সবই সম্ভব - পার্থক্য টা শুধু সময়ের।


ঋতুপর্ণা বসাক

Monday, June 20, 2022

ব্যথার কথা

 


আমাদের জীবনে খুব প্রচলিত এবং ব্যবহৃত একটা শব্দ হল ব্যথা। সবাই আমরা এর সঙ্গে ভীষণ ভাবে পরিচিত। আজ একটু ব্যথার কথাই শোনা যাক।

আচ্ছা ব্যথা দেখতে কি রকম হয়? তার কোন রং আছে কি - লাল, নীল, হলুদ, বা সবুজ? না কি সে শুধুই ধূসর বা সাদা বা কালো? ব্যথাও কি কখনও ব্যাথা পায়? সে কি কখনও কষ্টে কেঁদে ওঠে বা আনন্দে হেসে ওঠে? আমরা কি কখনও তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি বা তার মনের কথা জানার আগ্রহ দেখাই?

কখনও যদি ব্যথার সঙ্গে কথা বলা যায় তাহলে দেখা যাবে তারও হয়তো একটা জীবন আছে যেখানে সুখ দুঃখ, হাসি কান্না সব আছে। ব্যথাও হয়তো ব্যথা দিয়ে গান বাঁধে, কবিতা লেখে; কখনও আনন্দে নেচে ওঠে আবার কখনও হয়তো অভিমান করে বসে থাকে। ব্যথারও জীবনে হয়তো ঝড় আসে, সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে যায়, আবার সবশেষে নতুন করে সব শুরু করে।

ব্যথারও তো ভাগ আছে, তাদের সঙ্গে কি কখনও কথা বলেছি? শারীরিক বা মানসিক - দুই ব্যথার ব্যথা যে আবার দুরকম। শরীরিক ব্যথার হাজার ওষুধ আছে যা হয়তো সময়ের সঙ্গে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মানসিক ব্যথা? সে তো হাজার ওষুধেও যায় না, মনের কোন না কোন কোনায় রয়ে যায়। তার কি কিছু নিরাময়ের কোন চেষ্টা করি?

ব্যথার কি মন আছে? সেই মন কি কখনও রাগে, দুঃখে সব ছেড়ে হারিয়ে যেতে চায়? জানি না। হয়তো আছে; হয়তো সেই মন ব্যথা পেয়ে সব উৎসাহ হারিয়ে এক অজানার উদ্দেশ্যে নিখোঁজ হয়ে যেতে চায়, এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পাড়ি দিতে চায়। আবার কখনওবা ব্যথার সেই মন ব্যথা পেয়ে সমাধানের পথ খুঁজে তার ব্যথা সারানোর চেষ্টা করে।

ব্যথার জীবন কি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথালপাথাল করে না কি জলাশয়ের জলের মতো শান্ত স্থির থাকে? তার জীবনও হয়তো অনেক বৈচিত্রময়; কখনও উদ্দাম, বাঁধাহীন আবার কখনও বা ধীর, স্থির। কখনও প্রানোচ্ছল গতিতে আনন্দের সাথে এগিয়ে চলেছে, আবার কখনও নিশ্চুপ হয়ে বিষাদের গান গাইছে। ব্যথাও হয়তো কোথাও প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছে

ব্যথার থেকে সবাই পালাতে চায়, তাকে অস্বীকার করতে চায় যেন তার কোনও অস্তিত্বই নেই; বা তার কথা ভাবলে সে যেন বেশি কষ্ট দেবে। কিন্তু ব্যথার থেকে পালালে ব্যথা আরও আঁকড়ে ধরে কারণ ব্যথারও যে আর কেউ নেই যার সাথে সে কথা বলবে, যাকে সে তার মনের গাথা শোনাবে। তাই ব্যথার থেকে না পালিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে যদি তার কথা শোনা যায় তাহলে হয়তো তার ব্যথা কমবে এবং তার সাথে আমাদেরও কারণ ব্যথা তো আমাদেরই অংশ, সে তো আমাদের ভেতরেই আছে।


ঋতুপর্ণা বসাক

Saturday, May 28, 2022

ধন্যবাদ!

 

ধন্যবাদ

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজে থাকতে গেলে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয়, একে অপরের বিপদে আপদে সাহায্য করতে হয়, সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু সমস্যা হলো কাজ মিটে গেলে একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা ধন্যবাদ জ্ঞাপন না করা যা আজকের যুগে অত্যন্ত প্রবল।

'ধন্যবাদ' বা 'Thank you' খুব ছোট্ট শব্দ, কিন্তু তার অর্থ এবং ফল দুটোই খুব বড়। কাউকে ধন্যবাদ দেওয়ার অর্থই হলো তার কাজ বা সাহায্য বা সমর্থন কে উপলব্ধি করে তাকে স্বীকৃতি দেওয়া। এর ফলে সেই ব্যক্তির সমস্ত পরিশ্রম সার্থক হয় এবং সে তার সেই কাজের মধ্যে জীবনের আনন্দ খুঁজে পায়।

যখন আমাদের দরকার হয় তখন যার থেকে সাহায্য পাবো তাকে ব্যস্ত করে ছাড়ি। কিন্তু যেই কাজটা হয়ে গেলো আর তাকে মনে রাখি না, তার কাজের যথার্থ মূল্যায়ণ করার চেষ্টা করি না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সামান্য ধন্যবাদ টুকুও দিতে ভুলে যাই। জীবনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষজন আমাদের পাশে থাকে, সাহস যোগায়, সাহায্য করে; কিন্তু সবসময় আমরা বোধহয় তাদের যথার্থ সম্মান জানাতে পারি না। স্বয়ং ঈশ্বরকেও আমরা বাদ দিই না। তাঁর কাছে আমরা সবসময় চেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু যেই সেটা পেয়ে গেলাম আর তাঁকে মনে রাখি না। তাঁকেও যে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত সেটাই আমাদের মনে হয় না।

ধন্যবাদ সবসময় কথায় দেওয়া যায় না। বিভিন্ন মাধ্যমেও ধন্যবাদ প্রকাশ করা যায়, তা সে অর্থ হোক বা উপহার বা কোন কিছুর অঙ্গীকার। ধন্যবাদ শব্দের মাধ্যমে আমরা একে অপরের পরিশ্রমকে সম্মান জানাই যা আমাদের জীবনের পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহ যোগায়। ধন্যবাদ শব্দের মাধ্যমে আমরা একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে সাহায্য করে।

কাউকে বলা একটা ছোট্ট 'ধন্যবাদ' বা 'Thank you' হলো সেই জাদু চাবিকাঠি যা অনেক মনের বন্ধ দরজা খুলে সেখানে প্রবেশের অধিকার দেয়। ধন্যবাদ একজন মানুষের পরম কৃতজ্ঞতা,  নম্রতা এবং উপলব্ধিকে প্রকাশ করে। জীবনে শুভ অশুভ যাই আসুক না কেন তাকে গ্রহণ করে স্বীকৃতি দেওয়াই হলো জীবনের সমস্ত সম্পদের প্রধান ভিত্তি। কথায় বলে,

When life is sweet, say thank you and celebrate.

When life is bitter, say thank you and grow.


ঋতুপর্ণা বসাক

Thursday, April 28, 2022

দূরত্ব



'দূরত্ব' কথাটার মধ্যেই কেমন যেন একটা মন খারাপের গল্প লুকিয়ে রয়েছে। দূরত্ব মানেই যেন একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরী হবার গল্প তা সে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যে কোন রকম দূরত্বই হোক না কেন। সব ক্ষেত্রেই এই পাঁচিল গড়ে ওঠার পেছনে কোন কারণ অবশ্যই থাকে। কিছু দূরত্ব আমরা নিজেরা তৈরী করি আর কিছু কোন অদৃশ্য কারণ থেকে গড়ে ওঠে। কিছু দূরত্বের জন্য নিজেরাই দায়ী থাকি আবার কিছু দূরত্ব পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যায়।  

সমাজে থাকতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন লোকজন, পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হই; কোথাও সম্পর্ক খুব ভালো হয় কোথাও বা হয় না। অনেকক্ষেত্রে সম্পর্কে অসুস্থতা বোধ করলে সেখানে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যই সুস্থ থাকে।আবার অনেক ক্ষেত্রে সামান্য মনোমালিন্যে, ভুল বোঝাবুঝিতে দূরত্ব তৈরী হয়। দূরত্বের ফলে একে অন্যের গুরুত্ব বুঝতে পারে।সেক্ষেত্রে মিটিয়ে নেওয়ার একটা ইচ্ছে তৈরী হয়। কেউ কেউ সেটা বিভিন্ন প্রচেষ্টার দ্বারা মিটিয়ে নেয়, কেউ সেটা পারে না। যারা পারলো না সেখানে দূরত্বটা বাড়তে থাকে। আর এই ক্রমবর্ধমান দূরত্বটা একসময় এতটাই বেড়ে যায় যে হাজার চেষ্টা করেও সেটাকে আর মেটানো যায় না। সেই অদৃশ্য পাঁচিলটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতো বেশি মজবুত হয়ে যায় যাকে সামান্য ছেঁনি বা হাতুড়ি দিয়ে আর ভাঙা সম্ভব হয়ে ওঠে না। হ্যাঁ, হয়তো বুলডোজার চালিয়ে তাকে ভাঙা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য সেই বুলডোজার অর্থাৎ মনের ইচ্ছে এবং প্রচেষ্টা দুটোকেই সমান ভাবে, সবটা দিয়ে কাজে লাগাতে হবে; নিজের অহংকারকে দূরে সরিয়ে সদিচ্ছার সাথে সেই মনোমালিন্য দূর করার চেষ্টা করতে হবে; তবেই সেই পাঁচিল ভাঙতে পারে, দূরত্ব মিটতে পারে। 

কিছু দূরত্ব শত চেষ্টা করেও মেটানো যায় না। কোন প্রিয়জন যদি ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দেয়, সেই দূরত্ব মেটানো কোনভাবেই সম্ভব নয়; স্বয়ং ঈশ্বরও সেই দূরত্ব মেটাতে পারেন না। ইহলোকের সঙ্গে পরলোকের যোগাযোগের রাস্তাটা যে একমুখী, দূরত্ব মুছবে কি করে? এই জগতের মানুষ যতক্ষণ না ওই জগতে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ এই দূরত্ব বহাল থাকবে। আমরা তাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করি, তাদের অনুপস্থিতি অনুভব করি, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না, তাদের স্পর্শ করতে পারি না, তাদের সঙ্গে সুখ দুঃখ ভাগ করতে পারি না। তখন সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার গুরুত্ব আমরা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি।  বিভিন্ন উপায়ে আমরা তাদের মনে করি, বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কেউ তাদের চোখের জলে স্মরণ করে তো কেউ হাসিমুখে, আবার কেউ বা বিভিন্ন সমাজমূলক কাজের মাধ্যমে তাদেরকে স্মরণীয় করে রাখে। সেক্ষেত্রে মানসিক দূরত্বটা কোনোভাবেই থাকে না, কিন্তু ভৌত বা শারীরিক দূরত্বটা থেকেই যায় যা কোনোদিনও মেটানো সম্ভব নয়।

জীবন খুব দুর্লভ যাকে সযত্নে সস্নেহে বাঁচতে হয়। জীবনে উপস্থিত প্রত্যেকটি জীবের সাথে একটা সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলার চেষ্টা করতে হয় কারণ প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে প্রয়োজন হয়। কেউ বেশী কম, ছোট বড় নয়, সবারই সমান অধিকার, সমান গুরুত্ব রয়েছে। তাই যত বেশী আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকব আমরাই লাভবান হব। নইলে সামান্য কারণে তৈরী দূরত্বটা এতটাই বেড়ে যাবে যাকে হয়তো আমরা কোনোদিনও হাজার চেষ্টা করেও মেটাতে পারব না। তাই যতটা সম্ভব এই দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করা যাতে পাঁচিলটা ছোট থাকতেই তাকে আমরা ভেঙে ফেলতে পারি। কারণ মানব সৃষ্ট দূরত্বের ওপর আমাদের হাত আছে কিন্তু নিয়তির সৃষ্ট দূরত্বের ওপর নেই। পরলোকে পাড়ি দেওয়া প্রিয়জনের অভাব আমরা এতটাই অনুভব করি যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শূণ্যতা আরও বাড়ে বই কমে না। অগণিত চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে ছুঁতে না পারার কষ্ট, তার সঙ্গে কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা কমানোর কোনও ওষুধ আজ অবধি আবিষ্কৃত হয় নি। এই ক্ষতি বা লোকসান যা কিছু তা তো আমাদেরই! আর এই ক্ষতি স্বয়ং নিয়তিও পূরণ করতে পারে না কারণ তাঁরই তৈরী নিয়ম সবার জন্য সমান, তাঁর জন্যও!!!


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, April 17, 2022

হার - জিত


'হার' বা 'জিত' এই শব্দ দুটো আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি গুলোকে সূক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করে চলেছে। 'আমি হেরে গেছি' বা 'আমি জিতে গেছি' এটা যেমন একটা মানুষের ভাবনাকে বা চিন্তাধারাকে বর্ণনা করে, ঠিক তেমনি তার পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থার  মানসিকতারও পরিচয় দেয়। প্রত্যেকেই তার সেরাটা দেয়, সবাই জিততে চায়। তাই যখন কেউ হেরে যায় সমাজ যদি তার সেই পরিশ্রমের মূল্যটা দেয় এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার জন্য উৎসাহ জোগায় তাহলে হার টা আর দুঃখ মনে হয় না, সেটা আর হার থাকে না। তাই একটা জয় বা পরাজয় বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সাক্ষ্য বহন করে।

মানুষ ছোট থেকেই এই জয় বা পরাজয় ব্যাপারটা খুব ভালো করে শিখে যায়। কোনো শিশু যখন কোন প্রতিযোগিতা জেতে বা পরীক্ষায় ভালো ফল করে তখন চারপাশের সমাজের বাহবা, প্রশংসা তাকে বুঝিয়ে দেয় তার গুরুত্ব কতোটা। আবার যখন সে কোন কিছুতে হেরে যায় বা পরীক্ষায় কম নম্বর পায় বা ফেল করে তখনও চারপাশের মানুষদের তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা তাকে হতাশার সমুদ্রে ঠেলে দেয়। তাকে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে যতক্ষণ সে জিততে পারবে সবাই তাকে মাথায় করে রাখবে, আর হেরে গেলে হারিয়ে যাবে যার কেউ খোঁজও করবে না। হেরে যাওয়া এক বিশাল অপরাধ  - এই বার্তাই সবার কাছে পৌঁছানো হয়।

মানুষ ভুলে যায় যে একটা প্রতিযোগিতায় একজনই প্রথম হয়, সবাই প্রথম হয় না। তাই কাউকে না কাউকে তো হারতেই হবে। তাহলে তারা কোথায় যাবে? আর যারা জিতলো তারা তো সবসময় নাও জিততে পারে। হেরে গেলে যদি শুধু অবজ্ঞা, অবহেলা মেলে তাহলে জয়ীদের মনেও একটা ভয় কাজ করতে থাকে, একটা মানসিক চাপ মনের মধ্যে গেঁথে বসে। তাতে সমস্যা বাড়ে বই কমে না। হার জিত একটা তাৎক্ষণিক ব্যাপার, কিন্তু সমাজ একে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে এর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। হারটাকে শিক্ষা মনে করে যদি মেনে নেওয়া যায় তাহলে সেটা জয়ের থেকেও বড়ো হয়ে যায়, আর কোন সমস্যা, লজ্জা, বা ভয় থাকে না। সমাজ একটা সুস্থ ব্যাপার কে নিজেদের তৈরি দাঁড়িপাল্লায় ফেলে অসুস্থ করে তুলেছে। জয় মানে সবকিছু আর পরাজয় মানে কিছু না এই ভুল চিন্তাধারার বীজ সবার মনে বপন করে চলেছে।

জীবনকে জয় পরাজয়ের দাঁড়িপাল্লায় মেপে বিচার করা যায় না। জীবনে জয় পরাজয় দুটোরই সমান প্রয়োজনীয়তা আছে। জয় আমাদের পরিশ্রমের স্বার্থকতার আনন্দ দেয়, এগিয়ে নিয়ে যায়, অন্যকে পথ দেখাতে শেখায়। আর পরাজয় আমাদের ব্যর্থতার দুঃখ দেয়, ভুল থেকে শিক্ষা দেয়, নতুন করে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগায়। ব্যাপারটা অনেকটা অঙ্ক কষার মতো, হয় মিললো নয় মিললো নামিলে গেলে পরের অঙ্কে চলে যাবো, না মিললে আবার করতে হবে। ঠিক সেরকম জিতে গেলে এগিয়ে যেতে হবে আর হেরে গেলে সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে জেতার জন্য আবার তৈরি হতে হবে। দুটো অভিজ্ঞতাই দুরকম শিক্ষা দেয়। তাই জীবনের পথে দুটোরই সমান কৃতিত্ব রয়েছে। তাই জিতলে আমরা যেমন সেটা উদযাপন করি পরাজয়ও উদযাপন করা দরকার।

একটা সুস্থ মানসিকতার পেছনে জয় পরাজয় দুটোরই সমান ভূমিকা আছে। জয়ী হলে তার আনন্দ আর পরাজিত হলে তার দুঃখ দুটোই আমাদের জীবনের চড়াই উৎরাই এর সাথে পরিচয় করায়। আজ জিতলে কাল হারতেও পারি, আবার আজ হারলে কাল জিততেও পারি। কোন কিছুই স্থিতিশীল নয়, দুটো পরিস্থিতিকেই সমান ভাবে গ্রহণ করতে হয়। তাই জিতলে আনন্দে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই, আবার হারলে হতাশায় ডুবে যাওয়ার দরকার নেই। জীবন গতিশীল - আজ একরকম হলে কাল অন্যরকম হবে। জয়ের আনন্দ আর পরাজয়ের দুঃখ এই দুই অবস্থার সাথে পরিচয় থাকলে জীবনে যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়, কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। যে কোনও একটার সঙ্গে পরিচয়ে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। হার জিত উভয়ের মেলবন্ধন জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে, তাকে সম্পূর্ণ রূপ দেয়।


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, March 20, 2022

ভালো থাকা একটা মানসিকতা


"ভালো আছি" কথাটা আমরা সবসময় খুব সহজে বলতে পারি না, কোথাও একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। সে জায়গায় বরং 'চলে যাচ্ছে' কথাটা অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে বলে দিই। আসলে ভালো থাকাটা কোথাও যেন অনেক শর্তের সাথে জড়িত। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিক বিচার করে ভালো থাকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়। আর এই শর্তগুলি প্রত্যেক মানুষের কাছে আলাদা ভাবে প্রাধান্য পায়। কারও কাছে শারীরিক ভাবে ভালো থাকা খুব দরকার, আবার কারও কাছে অর্থনৈতিক ভালো থাকাটা সবচেয়ে জরুরী। তাই কে কিসে ভালো আছে সেটা সেই মানুষটাই বলতে পারবে। একজন যে শর্তে ভালো থাকবে অন্যজনও সেই একই শর্তে ভালো থাকবে এমনটা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। ভালো থাকাটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার

ভালো থাকা অনেকটা মানসিকতার ওপরও নির্ভরশীল। কারও সব থাকা সত্ত্বেও সে মনে করে যে সে ভালো নেই, আবার কারও কিছু না থাকা সত্ত্বেও সে মনে করে সে খুব ভালো আছে। মানুষ সবসময় অন্যের কি আছে আর নিজের কি নেই সেটা দেখে ভালো থাকা খারাপ থাকা বিচার করতে ব্যস্ত। তার কাছে কি আছে আর অন্যের কাছে কি নেই সেটা কখনও বিচার করে না। সে এটা কখনোই ভাবে না যে সে আজ যা পেয়েছে বা যেখানে পৌঁছাতে পেরেছে সেটা এখনও লক্ষ মানুষের স্বপ্ন যা পাওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে।

মানুষ চাহিদা আর প্রয়োজন এই দুটোর মধ্যে গুলিয়ে ফেলছে। 'অন্যের আছে আমার নেই' এই তুলনা থেকে চাহিদা বাড়ছে এবং মানুষ এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রমাণ করার জন্য নেমে  পড়েছে। প্রয়োজনটাকে যদি প্রাধান্য দিয়ে সেটাকে সীমাবদ্ধ করা যায় তাহলে ভালো থাকাটা হাতের মুঠোয়। কিন্তু যদি চাহিদার পেছনে ছোটে তাহলে কোনোদিনও ভালো থাকতে পারবে না কারণ 'আরও চাই' এই ইচ্ছেটা তাকে সারাজীবন ছুটিয়ে বেড়াবে, শান্তি দেবে না।

মানুষ যদি একে অপরের সাথে নিজেকে বড় দেখানোর প্রতিযোগিতায় না নেমে একে অপরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে, একে অপরের সঙ্গে সুখ দুঃখে অংশীদার হয় তবে ভালো থাকাটা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। যত একে অপরের সঙ্গে মনের কথা বলবে, বিপদে আপদে একে অপরের পাশে দাঁড়াবে তত তার লোকবল বাড়বে, বন্ধু বাড়বে, শুভাকাঙ্খী হবে এবং সে মানসিক ভাবে ভালো থাকবে যেটা জীবনে সবচেয়ে বেশি দরকার। যত মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে তত মানুষ সব দিক দিয়ে ভালো থাকবে এবং তার জন্য মানুষকে চাহিদা আর প্রয়োজনের মধ্যে পার্থক্যটা ভালো করে বুঝতে হবে। কথায় বলে,

"জীবনকে প্রয়োজনের মতো বাঁচতে হয়, চাহিদার মতো নয়।

কারণ প্রয়োজন ভিখারীরও পূরণ হয়ে যায় আর চাহিদা বাদশারও অপূর্ণ থেকে যায়।"


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, February 27, 2022

পুতুলখেলা

 

ছোটবেলায় পুতুল খেলেনি এমন মানুষ বোধহয় নেই তা সে পুরুষ মহিলা যেই হোক, কেউ কম কেউ বেশী। পুতুলখেলা জীবনের এক অনন্য শিক্ষা যা আমাদের এক রূপকথার জগতের সাথে পরিচয় করায় যেখানে সবাই সবাইকে ভালোবাসে, সকলে মিলেমিশে থাকে। পুতুলখেলা মানুষকে স্বপ্ন দেখতে শেখায় তা সে ছোটবেলা হোক বা বড়োবেলা।

বর্তমানে মানুষ যে জীবনযাপন করছে তাও তো একপ্রকার পুতুলখেলাই। কদিনের অতিথি মাত্র এখানে; থাকছি, খেলছি, শিখছি, কাজে লাগাচ্ছি এবং সব শেষে সব কিছু ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কোনো কিছু নিয়েও আসিনি, আর কোনো কিছু নিয়েও যাবো না। গীতায় নিষ্কাম কর্মের কথা এইজন্যই বোধহয় বলা হয়েছে। এই দ্বন্দ্ব, হিংসা, দ্বেষ সব এক কঠিন বাস্তব জীবনের অঙ্গ যার অন্তিমে কোনো মূল্যই থাকে না। এও এক পুতুলখেলা যেখানে বিভিন্ন চরিত্র তাদের জন্য নির্দিষ্ট রূপ, ভাব ও কাজের চরিত্রায়ন করে যাচ্ছে। জীবনের চড়াই উৎরাই এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পুতুল খেলছে বা কখনো নিজেরাই অন্যের হাতে পুতুল হয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো অন্যকে পুতুল হতে দেখে জীবনের শিক্ষা নিচ্ছে। তাই পুতুলখেলা এক অভিনব শিক্ষা। 

ছোট, বড়, সাদা, কালো, রঙিন হরেক রকম পুতুলের মতো মানুষের বিভিন্নতাও আমরা দেখতে পাই। যেরকম কোনো পুতুল বেশী পছন্দের, কোনটা কম সেরকম কোনো মানুষ খুব প্রিয় কেউ বা কম। ছোটবেলার পুতুলখেলা আমাদের বাস্তব জীবনের প্রথম পদক্ষেপের প্রাথমিক শিক্ষাটা দেয়। পুতুলখেলা হল বাস্তবের কঠিনতা কল্পনার মোড়কে পরিবেশিত হওয়া এক সুন্দর রূপকথা। এই রূপকথায় সবাই ভালো, সুন্দর, উপকারী এবং অনন্য। শৈশব থেকে এই পজিটিভ চিন্তা ভাবনায় শিশুদের তৈরী করার কারণ হয়তো তাদের মনে এই বিশ্বাসটা জাগানো যে এই পৃথিবীটা খুব সুন্দর। তাই এখানে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণও সুন্দর।  প্রথমেই যদি তাদের বাস্তবের কঠিনতা বা রূঢ়তা দেখিয়ে দেওয়া হয় তাহলে হয়তো তারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে পারে। হয়তো আর এগোতে নাও চাইতে পারে। তাই তাদের সেই ভীতি থেকে দূরে রেখে ধীরে ধীরে বাস্তবের কঠিনতার সাথে পরিচয় করাতে এই পুতুলখেলা যেখানে তারা শেখে জীবনে সমস্যা আসবে কিন্তু সেটা আবার চলেও যাবে। সবই ক্ষণস্থায়ী, চিরস্থায়ী কেউ নয়। গভীর ভাবে অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখলে বলা যায় আমরা সবাই পুতুল আর এক ঐশ্বরিক শক্তি আমাদের নিয়ে পুতুল খেলছে। তাই তো কবি নজরুল ইসলাম লিখেছেন,

"খেলিছ, এ বিশ্বলয়ে

বিরাট শিশু আনমনে,

খেলিছ, এ বিশ্বলয়ে

বিরাট শিশু আনমনে,

খেলিছ.....

প্রলয়সৃষ্টি তব পুতুলখেলা

নিরজনে প্রভু নিরজনে..."


ঋতুপর্ণা বসাক

Saturday, January 22, 2022

নিঃসঙ্গতা

 



নিঃসঙ্গতা জীবনের এক কঠিন বাস্তব রূপ যাকে কেউ আমরা অস্বীকার করতে পারি না। আক্ষরিক ভাবে এর অর্থ বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে দেবে যা নির্ভর করে তারা কিভাবে একে উপলব্ধি করেছে। 'নিঃসঙ্গ' শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই  এক নেগেটিভ বা দুঃখজনক অনুভূতি বা চিন্তা মনে আসে যা আমাদের এক গভীর দুঃখের সমুদ্রে নিমজ্জিত করে। কিন্তু অন্য ভাবে দেখলে এর উপকারী দিক টাও দেখা যায়। কারণ যখনই নিঃসঙ্গতা অনুভব করি তখনই নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি যা অন্যসময় আমরা ভাবি না।

ব্যস্ত জীবনের কোলাহলে আমরা নিজেদের মনের কথা শুনতে পাই না। আর ঠিক তখনই নিঃসঙ্গতা আমাদের সবাইকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। অবসাদের অতল গভীরে আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। 'আমি একা', 'আমার কেউ নেই' - এইসব কথাগুলো কেউ যেন আমাদের কানে কানে এসে সর্বদা বলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে চলতে আমরা যেন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি।

মানুষ এখন সবাই ব্যস্ত, সারাক্ষণ ছুটছে। তার নিজেকে দেবার মতোই সময় নেই তো অন্যকে কি সময় দেবে। যতক্ষণ অন্যদের সাথে আছি হইহুল্লোড় করে আনন্দ করে কাটাচ্ছি; যেই একা থাকছি নিঃসঙ্গতা অনুভব করছি। তাই সবাই আমরা নিঃসঙ্গ জীবনই কাটাচ্ছি। এইসব আনন্দ, হুল্লোড় সবকিছুই বহির্মুখী ব্যাপার। এরা ক্ষনিকের অতিথি; কিছুক্ষণের জন্য আসে, আনন্দ দেয়, তারপর চলে যায়; হৃদয় স্পর্শ করে না। সবকিছু যেন কেমন লোক দেখানো প্রতিযোগিতার অঙ্গ হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। হৃদয় তাকে অনুভব করল কি না বা হৃদয় আনন্দ পেলো কি না তাতে আমাদের কারও কিছু এসে যায় না, তা নিয়ে ভাবার সময় আমাদের নেই। আমরা সেই ক্ষনিকের বহির্মুখী আনন্দে মশগুল। তাই যেই সেটা অনুপস্থিত হচ্ছে এক গভীর শূণ্যতা আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। আমরা অবসাদে ভুগতে শুরু করছি। 

নিঃসঙ্গতা প্রকৃত অর্থে ভালো লাগার বস্তু নয়। কিন্তু যারা কোন সাধনা করছেন তা সে শিক্ষা সম্পর্কিত বা আধ্যাত্মিক বিষয় যাই হোক তাদের নিঃসঙ্গতা ভালো লাগে কারণ তাতে তাদের উন্নতি হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষদের জন্য এটা মোটেই সুখপ্রদ হয় না। ডাক্তাররাও একা থাকতে বারণ করেন, সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে বলেন। আর সত্যিই যদি কেউ নিঃসঙ্গ থাকেন তবে তাকে সেই একাকিত্ব কাটানোর রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে। তিনি বই পড়ে, ছবি এঁকে, গান করে বা লেখালেখি করে বিভিন্ন উপায়ে নিজের সময় কাটাতে পারেন। তার পছন্দের কাজ করে নিজের সুপ্ত ইচ্ছেগুলি পূরণ করতে পারেন, নিজেরা হারিয়ে যাওয়া গুনাবলীর পুনরায় বিকাশ ঘটিয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারেন।রাস্তা অনেক আছে কিন্তু সেটা খুঁজে বার করতে হবে।

তবে কোথাও কি এই শূণ্যতা, এই অবসাদের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী নই? আমরা আনন্দ কে বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অথচ ভালো করে অনুভব করলে দেখবো আমাদের অন্তরেই এক বিশাল রত্নভান্ডার আছে যাকে আমরা খোঁজ করার চেষ্টা কখনও করি না। তার জন্য মনকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্তরমুখী করতে হবে যাতে সে নিজেকে ভালোবেসে তাকে সময় দেয়। মন যেখানে উঁকি দিলে দেখা যাবে অনন্ত এক ভান্ডার আবিষ্কারের জন্য তার আবিষ্কারকের অপেক্ষায় দিন গুনছে। আর তাকে পেতে গেলে সেই পথের দিকে নির্ভীক চিত্তে এগোতে হবে, নিজেকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। নিজের মনের গভীরে ডুব দিতে হবে, ওপরে সাঁতার কাটলে তো হবে না।


ঋতুপর্ণা বসাক

শ্রোতা ও বক্তা

  শ্রোতা ও বক্তা শব্দ দুটো নিজেরাই নামের মধ্যে নিজেদের চারিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করে দেয়। একজন বলে একজন শোনে। যে বলে সে বক্তা, আর যে শোনে সে ...

Popular Posts