Thursday, April 28, 2022

দূরত্ব



'দূরত্ব' কথাটার মধ্যেই কেমন যেন একটা মন খারাপের গল্প লুকিয়ে রয়েছে। দূরত্ব মানেই যেন একটা অদৃশ্য পাঁচিল তৈরী হবার গল্প তা সে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যে কোন রকম দূরত্বই হোক না কেন। সব ক্ষেত্রেই এই পাঁচিল গড়ে ওঠার পেছনে কোন কারণ অবশ্যই থাকে। কিছু দূরত্ব আমরা নিজেরা তৈরী করি আর কিছু কোন অদৃশ্য কারণ থেকে গড়ে ওঠে। কিছু দূরত্বের জন্য নিজেরাই দায়ী থাকি আবার কিছু দূরত্ব পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যায়।  

সমাজে থাকতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন লোকজন, পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হই; কোথাও সম্পর্ক খুব ভালো হয় কোথাও বা হয় না। অনেকক্ষেত্রে সম্পর্কে অসুস্থতা বোধ করলে সেখানে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়। সেক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যই সুস্থ থাকে।আবার অনেক ক্ষেত্রে সামান্য মনোমালিন্যে, ভুল বোঝাবুঝিতে দূরত্ব তৈরী হয়। দূরত্বের ফলে একে অন্যের গুরুত্ব বুঝতে পারে।সেক্ষেত্রে মিটিয়ে নেওয়ার একটা ইচ্ছে তৈরী হয়। কেউ কেউ সেটা বিভিন্ন প্রচেষ্টার দ্বারা মিটিয়ে নেয়, কেউ সেটা পারে না। যারা পারলো না সেখানে দূরত্বটা বাড়তে থাকে। আর এই ক্রমবর্ধমান দূরত্বটা একসময় এতটাই বেড়ে যায় যে হাজার চেষ্টা করেও সেটাকে আর মেটানো যায় না। সেই অদৃশ্য পাঁচিলটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতো বেশি মজবুত হয়ে যায় যাকে সামান্য ছেঁনি বা হাতুড়ি দিয়ে আর ভাঙা সম্ভব হয়ে ওঠে না। হ্যাঁ, হয়তো বুলডোজার চালিয়ে তাকে ভাঙা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য সেই বুলডোজার অর্থাৎ মনের ইচ্ছে এবং প্রচেষ্টা দুটোকেই সমান ভাবে, সবটা দিয়ে কাজে লাগাতে হবে; নিজের অহংকারকে দূরে সরিয়ে সদিচ্ছার সাথে সেই মনোমালিন্য দূর করার চেষ্টা করতে হবে; তবেই সেই পাঁচিল ভাঙতে পারে, দূরত্ব মিটতে পারে। 

কিছু দূরত্ব শত চেষ্টা করেও মেটানো যায় না। কোন প্রিয়জন যদি ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দেয়, সেই দূরত্ব মেটানো কোনভাবেই সম্ভব নয়; স্বয়ং ঈশ্বরও সেই দূরত্ব মেটাতে পারেন না। ইহলোকের সঙ্গে পরলোকের যোগাযোগের রাস্তাটা যে একমুখী, দূরত্ব মুছবে কি করে? এই জগতের মানুষ যতক্ষণ না ওই জগতে পৌঁছাচ্ছে ততক্ষণ এই দূরত্ব বহাল থাকবে। আমরা তাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করি, তাদের অনুপস্থিতি অনুভব করি, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি না, তাদের স্পর্শ করতে পারি না, তাদের সঙ্গে সুখ দুঃখ ভাগ করতে পারি না। তখন সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার গুরুত্ব আমরা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি।  বিভিন্ন উপায়ে আমরা তাদের মনে করি, বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কেউ তাদের চোখের জলে স্মরণ করে তো কেউ হাসিমুখে, আবার কেউ বা বিভিন্ন সমাজমূলক কাজের মাধ্যমে তাদেরকে স্মরণীয় করে রাখে। সেক্ষেত্রে মানসিক দূরত্বটা কোনোভাবেই থাকে না, কিন্তু ভৌত বা শারীরিক দূরত্বটা থেকেই যায় যা কোনোদিনও মেটানো সম্ভব নয়।

জীবন খুব দুর্লভ যাকে সযত্নে সস্নেহে বাঁচতে হয়। জীবনে উপস্থিত প্রত্যেকটি জীবের সাথে একটা সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলার চেষ্টা করতে হয় কারণ প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে প্রয়োজন হয়। কেউ বেশী কম, ছোট বড় নয়, সবারই সমান অধিকার, সমান গুরুত্ব রয়েছে। তাই যত বেশী আমরা একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকব আমরাই লাভবান হব। নইলে সামান্য কারণে তৈরী দূরত্বটা এতটাই বেড়ে যাবে যাকে হয়তো আমরা কোনোদিনও হাজার চেষ্টা করেও মেটাতে পারব না। তাই যতটা সম্ভব এই দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করা যাতে পাঁচিলটা ছোট থাকতেই তাকে আমরা ভেঙে ফেলতে পারি। কারণ মানব সৃষ্ট দূরত্বের ওপর আমাদের হাত আছে কিন্তু নিয়তির সৃষ্ট দূরত্বের ওপর নেই। পরলোকে পাড়ি দেওয়া প্রিয়জনের অভাব আমরা এতটাই অনুভব করি যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শূণ্যতা আরও বাড়ে বই কমে না। অগণিত চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে ছুঁতে না পারার কষ্ট, তার সঙ্গে কথা বলতে না পারার যন্ত্রণা কমানোর কোনও ওষুধ আজ অবধি আবিষ্কৃত হয় নি। এই ক্ষতি বা লোকসান যা কিছু তা তো আমাদেরই! আর এই ক্ষতি স্বয়ং নিয়তিও পূরণ করতে পারে না কারণ তাঁরই তৈরী নিয়ম সবার জন্য সমান, তাঁর জন্যও!!!


ঋতুপর্ণা বসাক

Sunday, April 17, 2022

হার - জিত


'হার' বা 'জিত' এই শব্দ দুটো আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যা প্রতি মুহূর্তে আমাদের প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি গুলোকে সূক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করে চলেছে। 'আমি হেরে গেছি' বা 'আমি জিতে গেছি' এটা যেমন একটা মানুষের ভাবনাকে বা চিন্তাধারাকে বর্ণনা করে, ঠিক তেমনি তার পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থার  মানসিকতারও পরিচয় দেয়। প্রত্যেকেই তার সেরাটা দেয়, সবাই জিততে চায়। তাই যখন কেউ হেরে যায় সমাজ যদি তার সেই পরিশ্রমের মূল্যটা দেয় এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার জন্য উৎসাহ জোগায় তাহলে হার টা আর দুঃখ মনে হয় না, সেটা আর হার থাকে না। তাই একটা জয় বা পরাজয় বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের সাক্ষ্য বহন করে।

মানুষ ছোট থেকেই এই জয় বা পরাজয় ব্যাপারটা খুব ভালো করে শিখে যায়। কোনো শিশু যখন কোন প্রতিযোগিতা জেতে বা পরীক্ষায় ভালো ফল করে তখন চারপাশের সমাজের বাহবা, প্রশংসা তাকে বুঝিয়ে দেয় তার গুরুত্ব কতোটা। আবার যখন সে কোন কিছুতে হেরে যায় বা পরীক্ষায় কম নম্বর পায় বা ফেল করে তখনও চারপাশের মানুষদের তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা তাকে হতাশার সমুদ্রে ঠেলে দেয়। তাকে এটাই বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে যতক্ষণ সে জিততে পারবে সবাই তাকে মাথায় করে রাখবে, আর হেরে গেলে হারিয়ে যাবে যার কেউ খোঁজও করবে না। হেরে যাওয়া এক বিশাল অপরাধ  - এই বার্তাই সবার কাছে পৌঁছানো হয়।

মানুষ ভুলে যায় যে একটা প্রতিযোগিতায় একজনই প্রথম হয়, সবাই প্রথম হয় না। তাই কাউকে না কাউকে তো হারতেই হবে। তাহলে তারা কোথায় যাবে? আর যারা জিতলো তারা তো সবসময় নাও জিততে পারে। হেরে গেলে যদি শুধু অবজ্ঞা, অবহেলা মেলে তাহলে জয়ীদের মনেও একটা ভয় কাজ করতে থাকে, একটা মানসিক চাপ মনের মধ্যে গেঁথে বসে। তাতে সমস্যা বাড়ে বই কমে না। হার জিত একটা তাৎক্ষণিক ব্যাপার, কিন্তু সমাজ একে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে এর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। হারটাকে শিক্ষা মনে করে যদি মেনে নেওয়া যায় তাহলে সেটা জয়ের থেকেও বড়ো হয়ে যায়, আর কোন সমস্যা, লজ্জা, বা ভয় থাকে না। সমাজ একটা সুস্থ ব্যাপার কে নিজেদের তৈরি দাঁড়িপাল্লায় ফেলে অসুস্থ করে তুলেছে। জয় মানে সবকিছু আর পরাজয় মানে কিছু না এই ভুল চিন্তাধারার বীজ সবার মনে বপন করে চলেছে।

জীবনকে জয় পরাজয়ের দাঁড়িপাল্লায় মেপে বিচার করা যায় না। জীবনে জয় পরাজয় দুটোরই সমান প্রয়োজনীয়তা আছে। জয় আমাদের পরিশ্রমের স্বার্থকতার আনন্দ দেয়, এগিয়ে নিয়ে যায়, অন্যকে পথ দেখাতে শেখায়। আর পরাজয় আমাদের ব্যর্থতার দুঃখ দেয়, ভুল থেকে শিক্ষা দেয়, নতুন করে লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা জোগায়। ব্যাপারটা অনেকটা অঙ্ক কষার মতো, হয় মিললো নয় মিললো নামিলে গেলে পরের অঙ্কে চলে যাবো, না মিললে আবার করতে হবে। ঠিক সেরকম জিতে গেলে এগিয়ে যেতে হবে আর হেরে গেলে সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে জেতার জন্য আবার তৈরি হতে হবে। দুটো অভিজ্ঞতাই দুরকম শিক্ষা দেয়। তাই জীবনের পথে দুটোরই সমান কৃতিত্ব রয়েছে। তাই জিতলে আমরা যেমন সেটা উদযাপন করি পরাজয়ও উদযাপন করা দরকার।

একটা সুস্থ মানসিকতার পেছনে জয় পরাজয় দুটোরই সমান ভূমিকা আছে। জয়ী হলে তার আনন্দ আর পরাজিত হলে তার দুঃখ দুটোই আমাদের জীবনের চড়াই উৎরাই এর সাথে পরিচয় করায়। আজ জিতলে কাল হারতেও পারি, আবার আজ হারলে কাল জিততেও পারি। কোন কিছুই স্থিতিশীল নয়, দুটো পরিস্থিতিকেই সমান ভাবে গ্রহণ করতে হয়। তাই জিতলে আনন্দে ভেসে যাওয়ার কিছু নেই, আবার হারলে হতাশায় ডুবে যাওয়ার দরকার নেই। জীবন গতিশীল - আজ একরকম হলে কাল অন্যরকম হবে। জয়ের আনন্দ আর পরাজয়ের দুঃখ এই দুই অবস্থার সাথে পরিচয় থাকলে জীবনে যে কোনও পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে সুবিধা হয়, কোনও সমস্যায় পড়তে হয় না। যে কোনও একটার সঙ্গে পরিচয়ে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। হার জিত উভয়ের মেলবন্ধন জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে, তাকে সম্পূর্ণ রূপ দেয়।


ঋতুপর্ণা বসাক

শ্রোতা ও বক্তা

  শ্রোতা ও বক্তা শব্দ দুটো নিজেরাই নামের মধ্যে নিজেদের চারিত্রিক গুণাবলী বর্ণনা করে দেয়। একজন বলে একজন শোনে। যে বলে সে বক্তা, আর যে শোনে সে ...

Popular Posts